সফটওয়্যার ও যন্ত্রপাতির ভুয়া বিলের মাধ্যমে ক্রয় দেখিয়ে ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালের তিন চিকিৎসকসহ আট জনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সফটওয়্যার যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াত সম্প্রতি এ অভিযোগপত্রে দাখিল করেন। অভিযোগপত্র মামলার এজাহার নামীয় আসামিদের মধ্যে চারজন ও তদন্তে নতুন করে উঠে আসা আরও চারজনের নামে এ অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার জন্য আদালত আগামী বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াত বলেন, অভিযোগপত্রে নাম থাকা এজাহারে থাকা চার আসামি হলেন- ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মার্কেটাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের যৌথ মালিক মো. আব্দুস সাত্তার সরকার ও মো. হাসান হাবিব, বেঙ্গল সাইন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যালের মালিক মো. জাহির উদ্দিন সরকার ও ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশনের মালিক মো. আসাদুর রহমান। তবে মারা যাওয়ায় সামেক হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার শেখ শাহজাহানের নাম বাদ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, কমিশনের নির্দেশে গত ১৪ আগস্ট সাতক্ষীরার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তদন্তে নাম আসায় নতুন করে অভিযোগপত্র যুক্ত করা হয়েছে সামেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, ইএনটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার নারায়ণ প্রসাদ সান্যাল, শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুর রহমান ও মেডিকেল কলেজটির স্টোর কিপার হাসান হাবিব। সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
সামেক হাসপাতালের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগপত্রে নাম আসছে এমনটি জানতে পেরে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুহুল কুদ্দুসসহ চারজন দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর একটি আবেদন করেন। তদন্তকারি কর্মকর্তা তাদের আবেদনকে আমলে না নিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপরপরই ওই চার আবেদনকারি উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। একপর্যায়ে আদালত দুদকের প্রধান কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে সম্প্রতি স্বশরীরে মহামান্য হাইকোর্টে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বিধি বহির্ভূতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতীত সামেক হাসপাতালে ৬ কোটি ৬ লাখ ৯৯ টাকার পিকচার আর্কির্ভিং এন্ড কমিউনিকেশানস সিস্টেম (পিএসিএস) নামক সফটওয়্যারসহ সংশ্লিষ্ট ম্যাশিনারিজ কেনার উদ্যোগ নেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন তত্বাবধায়ক ডা. শেখ শাহাজাহান আলী। এ জন্য তিনি বাজারদর কমিটি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও সার্ভেকমিটি গঠনসহ ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহবান করেন। পরদিন দৈনিক আমার সংবাদ পত্রিকায় ও দি নিউজ টুডে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর স্বত্বাধিকারী আব্দুস সাত্তার সরকার ও আহসান হাবিব এবং বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিকেল এর স্বত্বাধিকারী মো. জাহেরউদ্দিন সরকার এর কার্যাদেশ পান। মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর আবেদনের ভিত্তিতে দরপত্রের বৈধতার মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই প্রায় সাত কোটি টাকা মূল্যের একটি পিকচার আর্কির্ভিং এন্ড কমিউনিকেশানস সিস্টেম (পিএসিএস) সফটওয়্যারসহ সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ সরবরাহের জন্য ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়।
ওই বছরের চার সেপ্টেম্বর মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল পিইসএস সফটওয়্যারসহ সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ সরবরাহের চালান ডা. শেখ শাহজাহানকে দেওয়া হয়। তিন সেপ্টেম্বর মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য কারিগরি সার্ভে কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি হিসেবে সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুহুল কুদ্দুস, সদস্য সচিব হিসেবে সহযোগী অধ্যাপক ডা. সামছুর রহমান (শিশু) ও সদস্য হিসেবে সহকারি অধ্যাপক ডা. নারায়ন প্রসাদ সান্ন্যালকে (নাক, কানও গলা) অর্ন্তভুক্ত করা হয়। মালামাল বুঝে না পাওয়ার পরও ২০১৮ সালের চার সেপ্টেম্বর সার্ভে সম্পন্ন করে চালানে সাক্ষর করেন সার্ভে কমিটির ওই তিন ডা. সদস্য। এরপর লেজারে লিপিবদ্ধ করার জন্য স্টোরকিপার আহসান হাবিবকে নির্দেশ দেন।
দুদক ২০১৯ সালের ১৫ মে সরেজমিনে তদন্ত করে ডা. শেখ শাহাজাহানের মেশিনারিজ কেনার যৌক্তিকতা ও ব্যবহারের নিয়ম-নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারেননি। দেখাতে পারেননি কোন মালামাল। ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সফটওয়্যার ও সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়নি মর্মে প্রতীয়মান হয়। সে অনুযায়ি সফটওয়্যার ও সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ তৃতীয় কাসটমার একসেপ্টেন্স দেওয়ার জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালিন তত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুহুল কুদ্দুস ও সহকারি অধ্যাপক ডা. সুতপা চ্যাটার্জীকে কমিটির সদস্য করা হয়। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালিন ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক উপ-সহকারি পরিচালক ফেরদৌস রহমান বাদি হয়ে সামেক হাসপাতালের তত্বাবধায়ক শেখ শাহাজান আলী, ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর স্বত্বাধিকারী আব্দুস সাত্তার সরকার ও আহসান হাবিব এবং বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিকেল এর স্বত্বাধিকারী মো. জাহেরউদ্দিন সরকার ও দিনাজপুরের ইউনিভার্সাল ট্রেড কর্পোরেশনের স্বতাধিকারী আসাদুর রহমানের নামে উল্লেখ করে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পিকচার আর্কির্ভিং এন্ড কমিউনিকেশানস সিস্টেম (পিএসিএস) নামক সফটওয়্যারসহ সংশ্লিষ্ট ম্যাশিনারিজ সরবরাহ না করে ভুয়া বিল দাখিল করে বিলের ভিত্তিতে সরকারের ৬ কোটি ৬ লাখ ৯৯ টাকা আত্মসাতে দুর্নীতি দমন কমিশন খুলনার সমন্বিত কার্যালয়ে মামলা দায়ের করেন।
জানা যায়, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক উপ-সহকারি পরিচালক ফেরদৌস রহমান বদলী হওয়ায় তদন্তভার বর্তায় ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারি পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াতের ওপর।
সাতক্ষীরার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিশেষ পিপি অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু বলেন, তিনজন ডাক্তারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সফটওয়্যার যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি গ্রহণের জন্য আগামী বছরের ২ ফেব্রয়ারি দিন ধার্য আছে। অভিযোগপত্রটি গৃহীত হলে স্বাক্ষীদের স্বাক্ষগ্রহণ করা হবে। এরপর আদালত রায় শুনাবেন।
আপনার মতামত লিখুন :