মোটেও ভালো নেই চায়ের রাজ্য। বাগানে বাগানে চলছে হাহাকার। কাজ নেই, হাজার হাজার চা-শ্রমিক বেকার। কাজের অভাবে পাগলপারা। ঘরে খাবার নেই, এক বেলা খেলে আরেক বেলার জন্য হাত পাততে হয় অন্যের কাছে। দেনার ভারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন তারা। কাজ ও ক্ষুধার জ্বালায় যখন শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা, তাদের জন্য ভাববার তখন কেউ নেই। দীর্ঘ ১১ সপ্তাহ ধরে শ্রমিক অষন্তোষ বাগানগুলোতে।
নানান দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকেরা। নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ বন্ধ রেখে শ্রমিকেরা রাজপথে। তাদের দাবিগুলোও যৌক্তিক। কিন্তু তা না শুনছে কোম্পানিগুলো, না শুনছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফলে না খেয়ে, না পরে একরকম মানবেতর জীবন যাপনের দিকে চলে গেছেন শ্রমিকেরা। এ কারণে বাগানে বাগানে এখন চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ।
বকেয়া মজুরি এবং ১৩ মাসের প্রভিডেনন্ট ফান্ডের (পিএফ) চাঁদা শ্রমিক তহবিলে জমা না দেওয়ার প্রতিবাদে শ্রমিকেরা টানা আন্দোলন করছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির প্রতি কখনোই কর্ণপাত করেনি। তারা বলছে, যেমন চলছে তেমন পোষালে কাজ করতে, না পোষালে কাজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে। যখন এমন করে বলা হয়, শ্রমিকেরা মুষড়ে পড়েন। তারা যেমন চলছে, তেমনটি মানেননি। কিন্তু এর জন্য ঘরেও বসে থাকেননি। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নেমে আসেন রাজপথে, আন্দোলনে। সেই থেকে তারা দাবি আদায়ের জন্য কর্মবিরতি পালন করছেন।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা রামভজন কৈরি জানান, বিভিন্ন সময়ে মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে এলেও শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। শ্রমিক পরিবারগুলো চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছে। তবে বেঁচে থাকার তাগিদে চা-বাগানের প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন।
এদিকে কর্মবিরতির ফলে শ্রমিকপাড়ায় নেমে এসেছে মানবিক দুর্যোগ। অর্থের অভাবে পড়ে এখন তারা চোখে শর্ষেফুল দেখছেন। যেমনটি চেয়েছে কোম্পানিগুলো। খাবারের অভাব ঘোচাতে দেনার পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছেন। দেনা শোধ করতে না পারায় মুদিদোকান থেকেও আর চাল-ডাল কিনতে পারছেন না কেউ কেউ। অনেকে বাধ্য হয়ে লতাপাতা খেয়ে দিন পার করছেন। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে শিশুরা।
ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান জানান, চা-শ্রমিকদের রেশন হিসেবে আটা দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত বকেয়া পরিশোধ করে বাগানের স্বাভাবিক কার্যক্রম সচল করতে হবে। আশা করা হচ্ছে, ২ ডিসেম্বরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের শ্রমিক সীতারাম। থাকেন তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে শ্রমিকপাড়ায়। তার স্ত্রীও চা-শ্রমিক। সন্তানেরা ছোট। বড় সন্তান পড়ছে স্কুলে। ‘এক মাস হবে, মুখে মাছ-মাংস পড়েনি। দিনে এক বেলা খাই। তাও পান্তাভাত। শাক-সবজি জোগাড় করতে পারলে সেটিই খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।’ বললেন সীতারাম। চা-বাগানের শ্রমিক তিনি বাপ-দাদার আমলে পাওয়া ঐতিহ্য হিসেবে। পড়াশোনা নেই। শেখেনওনি। বাগানে বাবা-মাকে চা-পাতা তুলতে দেখেই বড় হয়েছেন। নিজেও একদিন হয়ে উঠেছেন চা-শ্রমিক। তাই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি।
‘আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন কেউ করতে চায় না। কে করবে? এখন যখন না খেয়ে আছি, না পরে আছি, সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার দিতে পারছি না, তখন তো কেউ এগিয়ে আসছে না।’ যোগ করলেন তিনি। তার মধ্যে চরম হতাশা। বললেন, এভাবেই মনে হয় আমাদের সাত পুরুষ শুধু গায়ের শ্রম দিয়েই যাবে, কিন্তু কিছুই পাবে না। পরিবর্তন হবে না।’
সূত্র জানায়, দেশের ১৬৮টি চা-বাগানের মধ্যে ১৩৬টির অবস্থান সিলেট বিভাগের তিন জেলায়। সিলেটের মালনিছড়া চা-বাগান থেকেই ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের চা উৎপাদনের যাত্রা শুরু। এসব চা-বাগানে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। সেই শ্রমিকেরা এখন কাজে যাচ্ছেন না। সিলেটের ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) লাক্কাতুরা, কেওয়াচড়া ও দলদলি চা-বাগানের শ্রমিকসহ অন্য বাগানের কেউই কাজে যোগ দিচ্ছেন না।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে এনটিসির মালিকানাধীন আটটি চা-বাগান রয়েছে। পাত্রখোলা, চাম্পারায়, কুরমা, কুরঞ্জি, বাঘাছড়া, মাধবপুর, পদ্মছড়া ও মদন মোহনপুর চা-বাগানের ৮ হাজারের মতো শ্রমিক বেকার হয়ে বসে আছেন।
শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, তারা বর্তমানে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। সেই মজুরি সপ্তাহান্তে না পেলে অবর্ণনীয় মানসিক বিপর্যয়ে পড়তে হয়।
তারা জানান, এনটিসি ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ছোট-বড় ১৮টি চা-বাগানে চলছে শ্রমিকদের কর্মবিরতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে এনটিসি। এই কোম্পানিতে সরকারের ৫১ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান এনটিসির চা-বাগানগুলো তীব্র অর্থসংকটে রয়েছে। চায়ের উৎপাদন বন্ধ থাকায় অর্থসংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে এমনটাই আশঙ্কা করছেন মালিক ও শ্রমিকেরা। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন ১২টি কারখানা রয়েছে সিলেটে। বাগান রয়েছে ১৮টি, যার সবগুলোই বর্তমানে চা উৎপাদনের বাইরে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে পাতা। সংশ্লিষ্ট মহল ‘এর প্রভাব চায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পড়বে’ বললেও সংকট সমাধানে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে চুপচাপ রয়েছে।
বাগান সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর এনটিসির চেয়ারম্যান ও সাত পরিচালক একযোগে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এতে আটকে যায় ব্যাংকঋণ। ফলে অর্থসংকটে পড়ে এনটিসি। আগস্টের ১৫ তারিখ থেকে বন্ধ হয়ে যায় শ্রমিকদের মজুরি ও রেশন। কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির আহমেদ আত্মগোপনে রয়েছেন। পরিষদের সাতজন পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। আকস্মিক এই পরিস্থিতিতে তীব্র সংকট দেখা দেয়। সম্প্রতি সরকার এনটিসির নতুন এমডি নিয়োগ দিয়েছে। তবে তিনি এসেও শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে পারছেন না।
চা-শ্রমিকেরা বলেন, ‘টানা ১১ সপ্তাহ ধরে আমরা আন্দোলন করছি। আমাদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে মালিকপক্ষ স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। ব্যাংকে টাকা না থাকাসহ বিভিন্ন অজুহাতে মজুরি দিচ্ছেন না বাগানমালিক বা কোম্পানিগুলো। তবে তাদের অভিযোগ, তাদের বেতন পরিশোধ না করলেও বাগানের ম্যানেজার বা অন্যরা ঠিকই বেতন পাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ধস নেমেছে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যেও। চা উৎপাদন কারখানা সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের আগস্ট থেকে তাদের তহবিলে অর্থের সংকট দেখা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের তলব, রেশনসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ বাগান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তিন মাস ধরে বাগানের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে আছে। রেশন ও তলব না পেয়ে শ্রমিক পরিবারে দেখা দিয়েছে তীব্র অভাব। তাই বকেয়ার দাবিতে চলছে শ্রমিকদের কর্মবিরতি।
কমলগঞ্জের চণ্ডীছড়া চা-বাগানের জেনারেল ম্যানেজার সেলিমুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ সপ্তাহ হবে বাগান বন্ধ। শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে এক মাস হবে। এই সময়ের মধ্যে চা-গাছের পাতাগুলো বড় হয়ে গেছে। বাগান অনেক পরিমাণে লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে।
গত বছরও রেকর্ড গড়ে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায় বন্ধ থাকা চা-বাগানগুলোতে। এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি। তবে উৎপাদনে ভাটা পাড়ায় এবার লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
কমলগঞ্জের প্রেমনগর বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুভাষ কর্মকার বলেন, ‘এটা ঠিক যে, মজুরি না পেয়ে আমরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। তবে মালিকপক্ষ বকেয়া মজুরি পরিশোধ না করলে কাজে ফিরব না। বাজারে যে হারে জিনিসপত্রের দাম, তাতে বাগানবাসীর অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাদের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিদ্যালয়ের বেতনও ঠিকভাবে দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহের বুধবার চা-বাগানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। বিকেল হলেই চা-শ্রমিকেরা লাইন ধরে তাদের সাপ্তাহিক রেশন ও তলব নিয়ে যেতেন। সেই টাকা দিয়ে বাগানের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু কোনো বাগানেই এখন সেই দৃশ্য নেই। আছে হাহাকার, বঞ্চনা-হতাশা আর দুশ্চিন্তা।
আপনার মতামত লিখুন :