ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

চুয়াডাঙ্গার ২৬ জন ইতালি যাওয়ার পথে জিম্মি, চাওয়া হচ্ছে মুক্তিপণ

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৪, ০৭:০৮ পিএম

চুয়াডাঙ্গার ২৬ জন ইতালি যাওয়ার পথে জিম্মি, চাওয়া হচ্ছে মুক্তিপণ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চুয়াডাঙ্গায় উপজেলার নওদা বন্ডবিল গ্রামের সজিব আহম্মেদকে ইতালি পাঠাবেন বলে তাঁর বাবা শহীদুল ইসলাম ১১ মাস আগে একই উপজেলার বেলগাছী গ্রামের ঠান্টুর ছেলে জীমের নিকট প্রথমে ১০ লাখ টাকা নগদ তুলে দেন। মাস ছয়েক আগে সজিব আহম্মেদ যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নযাত্রা সফল হয়নি। এখন তিনি লিবিয়ায় আছেন তিনিসহ একই এলাকার ২৬ জন জিম্মি অবস্থায়। তাঁদের লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে পরিবারের কাছে থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, চক্রের সদস্যরা বাড়িতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ১০-১৫ লাখ টাকা করে দাবি করছেন। অন্যথায় তাঁদের হত্যা করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা হলেন- আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছী জিম, হাউসপুর গ্রামের মামুনুর রশিদ, খেজুরতলা গ্রামের মিঠুন, তুহিন হক, তিতাস, জুয়েল রানা, হাসিবুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম, বকুল হোসেন, নয়ন হক, আবু সাঈদ, জুনায়েদ হাসান প্লাবন, আবু জাফর, সাগর আলী, মিল্টন আলী, মোশারফ আলী, বিপুল হোসেন, নিশান মিয়া, আব্দুল্লাহ জাহিদ, একই উপজেলার পৌর এলাকার গোবিন্দপুর সজিব হোসেন, হৃদয় আহমেদ টিটন, জহুরুলনগরের সবুজ আলী, কাবিলনগর গ্রামের বিপ্লব হোসেন, ঘোলদাড়ি গ্রামের সনজিত কুমার ও কেশবপুর গ্রামের মামুন আলী, নির্যাতিতদের পরিবার ও স্বজনরা বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টায় চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন।

ভুক্তভোগী নওদা বন্ডবিল গ্রামের সজিব আহম্মেদের ভাগ্নে হারুন বলেন, আমার মামাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে বেলগাছী গ্রামের ঠান্টুর ছেলে জীম ১০ লাখ টাকা নগদ নিয়েছে। এখন মামাকে মুক্ত করতে চাচ্ছে ১০ লাখ টাকা। চেষ্টা করেও এত টাকা জোগাড় করতে পারছি না। একই অভিযোগ খেজুরতলা গ্রামের জুয়েল রানার স্ত্রী পলি খাতুনের।

তিনি জানান, আমার স্বামী গ্রামে কৃষি কাজ করতো। তাকে ইতালিতে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ লাখ টাকা দাবি করে লিবিয়া প্রবাসী সাগর, তার চাচাতো ভাই জীম ও সাগরের পিতা জান্টু মেম্বার। ফেরুয়ারি মাসে লিবিয়া পৌঁছানো পর তিনি এখন জিম্মি। প্রতিদিন খাওয়া দেয় না। মারধর করে আর মোটা অঙ্কের টাকা চায়।

আলমডাঙ্গা উপাজেলার চরযাদবপুর গ্রামে সাবিনা খাতুন নামে আরেক নারী জানান, আমার একমাত্র ভাই একই উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের আব্দুল্লাহ জাহিদ দিপু। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। ইতালিতে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের নিকট ১৫ লাখ টাকা দাবি করেন। আমি প্রথমে বিভিন্ন এনজিও থেকে আমার স্বামীকে গ্যারান্টার রেখে ৭ লাখ টাকা লোন এবং আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে আরও ৩ লাখ টাকা নিয়ে মোট ১০ লাখ টাকা জোগাড় করি। প্রথম সেই ১০ লাখ টাকা জীম, জান্টু মেম্বারের হাতে তুলে দিই। টাকা দেয়ার সময় তাদেরকে আমি জানাই, আমার এই ভাই ছাড়া আপনজন কেউ নেই। সুতরাং আপনারা যদি ভালোভাবে ইতালি নিয়ে যেতে পারেন তাহলে টাকা নেন। না হলে আমার ভাইকে আমি পাঠাবো না। ওই সময় অভিযুক্তরা আমাকে আশ্বস্ত করেন করে বলেন তোমাদের সাথে কথা হয়েছে ১৫ লাখ টাকার। এখন ১০ লাখ টাকা দাও বাকী ৫ লাখ টাকা তোমার ভাই সেখানে পৌঁছানোর পর দিতে হবে। তোমার ভাই সেখানে গিয়ে মাসে ১ লাখ টাকা বেতন পাবে। যেদিন বাংলাদেশ থেকে আমার ভাই সেখানে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় ওইদিনই আমার কাছে বাকী ৫ লাখ টাকা দাবি করে জীম। কিছুদিন পর আমার ভাই আমার মোবাইলে কল করে নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। ওই সময় সে জানায় আপা আমি আজ দুইদিন যাবত কিছু খাইনি। এরা আমাকে অকথ্য নির্যাতন করছে। কিছু খেতে দিচ্ছে না। তখন আমি আমার ভাইয়ের কথা চিন্তা করে প্রায়ই ৫ হাজার থেকে শুরু করে যখন যা পারি সাগর দালালকে দিতে থাকি। এর কিছুদিন পর আবার আমার কাছে ফোন দিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিই তবে আমার ভাইকে মেরে ফেলা হবে। আমি হতভম্ব হয়ে আবারও এনজিও থেকে ৩ লাখ ও বাড়ির জমি বিক্রি করে ২ লাখ মোট ৫ লাখ টাকা জীমের হাতে তুলে দিই।

নির্যাতন এখনও থামেনি। প্রায়ই আমার কাছে ফোন দিয়ে আরও টাকা দাবি করে। বর্তমানে আমার আর কিছু নেই। এখন শ্বশুরবাড়িতে আমাকে নানা কথা শুনতে হচ্ছে। মরন ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। গত ৪-৫ ধরে আমার কাছে দালাল সাগর প্রতিনিয়ত ফোন দিচ্ছে ২ ঘণ্টার মধ্যে ২২ লাখ টাকা দিতে হবে। জীম ও জীবন প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে এসে টাকা
চাচ্ছে।

নাগদাহ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার রকিবুল জানান, বেলগাছী ইউনিয়নের জান্টু মেম্বারের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী দালাল সাগরের প্রলোভনে পড়ে তার পিতা জান্টু, ভাই জীবন, চাচাতো ভাই জীম, চাচা ঠান্টু, চাচী স্কুল শিক্ষিকা বেদেনা, সাগরের মা আমেনাসহ বিভিন্ন নিকটজনের মাধ্যমে এখানে উপস্থিত ভুক্তভোগীরা কারও ভাই, কারো ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য ১৫ লাখ করে টাকা দেন। বর্তমানে আমি এদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি বলে অভিযুক্তরা আলমডাঙ্গায় আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে
ভুক্তভোগীদের ন্যায় বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইতালি পাঠানোর কথা বলে সাগর ও জীবনের বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। ভুক্তভোগী কয়েকজন থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

আরবি/জেডআর

Link copied!