গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের কাওরাইদ মধ্যপাড়ার বাসিন্দা মো. শাহজাহানের ছেলে মোহাম্মদ শরীফ ও আরেক ছেলে কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক কাওরাইদ ৩নং ওয়ার্ড নেতা জাকির। শরীফ শ্রীপুর থানায় কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। ছোট চাকরি করলেও তিনি বর্তমানে প্রায় তিন কোটি টাকার একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক। মামলার ভয় দেখিয়ে, সুদের টাকার ব্যবসা করে ও ঘুষ বাণিজ্য করে বর্তমানে তিনি কোটিপতি ব্যক্তি। ঢাকার সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদকে ঘুষ দিয়ে নিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি। মাত্র ৭-৮ বছরে শরীফ বনে গেছেন কোটি কোটি টাকা ও অবৈধ সম্পদের মালিক। স্থানীয় বাসিন্দা, সরেজমিন তথ্য ও শরীফের বিরুদ্ধে দুদকে দেওয়া অভিযোগ সূত্রে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রামসালিশ পরিচালনাকারী সিরাজুল হক মিঠা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, রাতারাতি এত টাকা সৎ পথে অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে পরিবারকে ১০ বছর আগে দেখেছি সমাজে চলতে কষ্ট হয়, সে পরিবার হঠাৎ করেই মাত্র ৭-৮ বছরে কীভাবে এত টাকার মালিক হলো, এটা ভেবে দেখার বিষয়।
কাওরাইদের আরেক বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শরীফের চাকরিটা আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ঢাকার সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ যখন গাজীপুরের এসপি ছিল তার বডিগার্ডের নামও ছিল আমার নামেই নাম কুদ্দুস। তার মাধ্যমে হারুনকে ৮ লাখ টাকা এবং কুদ্দুসকে এক লাখ টাকা দিয়ে এই চাকরিটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।
বিনিময়ে আমাকে একটি শার্ট পিস, একটি প্যান্ট পিস ও একটি লুঙ্গি উপহার দেয় কনস্টেবল শরীফের পিতা। তিনি আরও বলেন, সৈনিক পুলিশের নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে বিবাহিত হতে পারবে না কিন্তু শরীফ বিবাহিত ছিল, সে সময় যারা তদন্ত এসেছিল তাদের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করেই চাকরি রক্ষা করা হয়।
সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, কনস্টেবল শরীফের রয়েছে সুদের ব্যবসা। যেকোনো মানুষকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা প্রদান করেন। প্রতি লাখে মাসে ১০ হাজার টাকা করে সুদ গ্রহণ করেন। কথিত আছে, তার এলাকায় প্রায় দুই কোটি টাকার মতো সুদের টাকা ঘুরছে।
ভুক্তভোগী আব্দুল জব্বার বলেন, আমি ২ লাখ টাকা সুদে নিয়েছি খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে। এসব বিষয়ে আমি কোনো কথা বললে স্ট্যাম্পে মনমতো লিখে মামলা দিয়ে দেবে। এমনিই তো সুদের টাকা ঠিকঠাক মতো না দিলে মারধর খেতে হবে। সুদের টাকার জন্য এখন পর্যন্ত অনেক মানুষকে ওই খালি স্ট্যাম্পে মনমতো লিখে মামলাও দিয়েছে।
কনস্টেবল শরীফের ভাইয়ের কাছ থেকে এবং শরীফের মাধ্যমে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরিত অনেক স্ট্যাম্প রূপালী বাংলাদেশের হাতে আসে।
গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে কেঁচো খুঁড়তে সাপ। বিভিন্ন মানুষের জায়গা সম্পত্তি দখল করা, সুদের টাকার জন্য মানুষকে নির্যাতন করা, মামলা-হামলার ভয় দেখানো এ যেন সাধারণ বিষয়। সুদের টাকা নিয়ে বিবাদে থাকা নুরুল হক মামলার ভয়-ভীতিতে এখন শয্যাশায়ী।
কাওরাইদ এলাকার আরেক বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বেপারী বলেন, পুলিশের ভাই ৩নং ওয়ার্ডের কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির একটা সময় ছাগল চুরি, ভ্যানচুরি, রিকশা চুরি এবং বর্তমানে অটো চুরির সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন আগে থানায় একটি অভিযোগে আমি স্বাক্ষর দেওয়াতে আমার ওপর তার পরিবার অনেক চাপ দেয় কিন্তু আইনগত কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, সাবেক আওয়ামী লীগ এমপি ও প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী টুসির সঙ্গে জাকিরের বেশ ভালো সখ্য রয়েছে। যার প্রভাবে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তার পরিবারের ওপর কথা বলা প্রত্যেকটা মানুষকেই তারা বিভিন্ন মামলার আওতায় নিয়ে আসে।
পিডিবির এক সাবেক কর্মচারী বলেন, চাকরির সুবাদে আমাকে এলাকার বাইরে থাকতে হতো, রিটায়ারমেন্টের পরে বাড়ি এসে দেখি আমার ১৫ শতাংশ জমি তারা দখল করে নিয়েছে। কনস্টেবল শরীফের দাপটের কারণে সবাই চুপ থাকে; আমারও একই অবস্থা।
আরেক ভুক্তভোগী নাম-পরিচয় না দেওয়ার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমার জায়গার মধ্যে এখন বালু-পাথর এনে রেখেছে। আমার থেকে দলিলও করে নেয় নাই, টাকাও দেয় নাই। জোরপূর্বকভাবেই আমার জায়গার ভোগদখল করছে।
মেধাবিকাশ হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক বলেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে একবার অভিযোগ দিয়েছিলাম, তার ফলটা হচ্ছে, আমাকে গাঁজা ব্যবসায়ী বানিয়ে ফেসবুকে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি শিক্ষক মানুষ, মানসম্মানের ভয়ে এখন দেখেও না দেখার ভান করে চলি। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, এক ইতালি প্রবাসী থেকে হুন্ডির টাকা বাবদ ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে এই কনস্টেবল শরীফ।
গাজীপুরের শ্রীপুরে পুলিশ কনস্টেবলের আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি, একাধিক গাড়ি, অঢেল সম্পদ, বিভিন্ন মানুষকে নির্যাতন করে মামলার হুমকিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে প্রধান উপদেষ্টা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, কনস্টেবল শরীফের ভাই কাওরাইদ ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির শেখের দাপটে সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনের ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে টাকা কামিয়ে নিজ গ্রামে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। উপজেলার টেংরা মধ্যপাড়ায় তার পিতা শাহজাহানের নামে কিনেছেন জমিসহ বাড়ি, রয়েছে একাধিক গাড়ি, অবৈধ কালো টাকার পাহাড়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দাগ নং-১৪০/১৪১ কাওরাইদ মৌজায় পুলিশ কনস্টেবলের দৃষ্টিনন্দন এ ডুপ্লেক্স বাড়িটি। স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি করে ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া বাড়ি, গাড়ি, জমি, এতকিছু করা সম্ভব নয়।
এলাকাবাসীর একজন শামীম বলেন, আমাদের দুই একজন ভাই পুলিশের চাকরি করে তারা তো ঠিকমতো সংসার চালাতে হিমশিম খায়। সাধারণ একটি বাড়িই করতে পারে না। তাহলে শরীফ কীভাবে এতকিছু করল!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বলেন, বেশ কয়েকদিন আগে শরীফ ৩০-৩৫ লাখ টাকা মূল্যের দুটি প্রাইভেটকার কিনেছেন। গাড়িগুলো বাড়িতেই থাকত। বর্তমানে গাড়িগুলো অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।
স্থানীয় ঝন্টু বলেন, এত অল্প সময়ে পুলিশ কনস্টেবলের বাড়ি, গাড়ি, টাকার মালিক কীভাবে হলেন, আমাদের বোধগম্য নয়! দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তের মাধ্যমে তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাকে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করুক।
ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল শরিফুলের মোবাইল নম্বরে কল করলে প্রথমে তিনি গাড়িতে আছেন বলে কল কেটে দেন। রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদক তার বাসায় গিয়ে তার অনুসন্ধান করার কারণে পরবর্তীতে ফোন করলে বলেন আপনার হাতে দুদকের অভিযোগের কাগজ ছিল আপনি দুদক থেকে এসেছেন এই পরিচয় আমার মাকে দিয়েছেন। তাই আপনার সঙ্গে কোনো কথা বলব না। এরপর থেকে অনেকবার ফোন দিয়ে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।
তবে তার ভাই জাকির বলেন, এগুলো সব মিথ্যা কথা। আমরা ন্যায় বিচারের জন্য চেষ্টা করছি। এলাকাবাসী আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। আমাদের সব সম্পত্তির বৈধ সব কাগজপত্র আছে। কিন্তু রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদককে আব্দুল কুদ্দুস যে তথ্য ভিডিও ও মৌখিক বক্তব্য প্রদান করেন, সেজন্য কনস্টেবল শরীফ বাহিনী জোরপূর্বক তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এই ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে জিডি করতে বাধ্য করে। তবে কর্মরত ওসি জিডিটি গ্রহণ করেননি।
শ্রীপুর থানার ওসি জয়নাল আবেদীন বলেন, কনস্টেবল শরীফ ও তার ভাই জাকিরের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমার হাতে এসে এখনো পৌঁছেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :