ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

পরিবেশ-প্রকৃতির পালাবদলে হারিয়ে যাচ্ছে ডলু বাঁশ

এম. মাহমুদুর রহমান আলতা, কমলগঞ্জ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ০৯:১৮ পিএম

পরিবেশ-প্রকৃতির পালাবদলে হারিয়ে যাচ্ছে ডলু বাঁশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য চুঙ্গা পিঠা ও পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ডলু বাঁশ। দিনে দিনে বদল হচ্ছে মানুষের রুচিবোধ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনপদ মৌলভীবাজারের প্রাচীন ঐতিহ্য পিঠা-পুলির অন্যতম চুঙ্গা পিঠা ও পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ডলু বাঁশ প্রায় বিলুপ্তের পথে। আগের মতো এখন আর গ্রামীণ এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চুঙ্গা পুড়ার আয়োজন চোখে পড়ে না। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গা পুড়ার দৃশ্যও তাই দেখা যায় না। পৌষ সংক্রান্তিতে ডলু বাঁশ আর চুঙ্গা পিঠা গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ ছিল। আগুনে পুড়িয়ে বাঁশের ভেতরে বিন্নি চাল, বিন্নি চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি এই পিঠা শীতের সকালকে উষ্ণতায় ভরিয়ে রেখেছে একটা সময়। কিন্তু পরিবেশ-প্রকৃতির পালাবদলে ডলু বাঁশ, বাঁশ পোড়ানোর উপকরণ দুর্লভ হওয়ায় চুঙ্গা পিঠা ক্রমে হারিয়ে যাওয়ার পথে। চুঙ্গা পিঠা মৌলভীবাজারে পরিচিত একটি নাম। বাঁশ পুড়িয়ে তৈরি হওয়ায় অনেকের কাছেই এই পিঠার আলাদা আকর্ষণ আছে। তবে এখন এই পিঠা তার ঐতিহ্য-গৌরব হারানোর পথে। শুধু পৌষসংক্রান্তির সময় এলেই জেলার কিছু হাট-বাজারে চুঙ্গা পিঠা তৈরির উপকরণ ডলু বা কালি বাঁশের দেখা মেলে।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকার ডবলছড়া পুঞ্জি ও ইসলামপুরে, বড়লেখার পাথরিয়া পাহাড়, জুড়ীর লাঠিটিলা ও চুঙ্গাবাড়ি, কুলাউড়ার গাজীপুরের পাহাড়, রাজনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার টিলা ও চা-বাগানের টিলায় প্রচুর ডলু বাঁশ পাওয়া যেত। তন্মধ্যে চুঙ্গাবাড়ি এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল ডলুবাঁশের জন্য। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহাড়খেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ডলু বাঁশ। তবে জেলার কিছু কিছু টিলায় এখন ও ডলু বাঁশ পাওয়া যায়।

ডলু বাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না। কারণ ডলু বাঁশে এক ধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ডলু বাঁশে অত্যধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। ডলু বাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে। চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ-চিনি, নারিকেল ও চালের গুড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা করা যায়। চুঙ্গাপিঠা পোঁড়াতে আবার প্রচুর পরিমাণে ধাঁনের খড় দরকার পড়ে।

শীতকালে বিশেষ করে পৌষসংক্রান্তির সময়টিতে এই পিঠা তৈরি হয়। একসময় অনেকটা নিয়মের মতো ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির আয়োজন ছিল। নিজেরা খেতেন, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হত। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তৈরি পিঠা পাঠাতেন। এটি চুঙ্গা পিঠা, বাঁশ পিঠা বা চুং পিঠা নামে ও পরিচিত। শীতের এই সময়ে ধানের শুকনা খড়, ঢেঁকিছাঁটা চাল, প্রয়োজনীয় বাঁশ ও স্থানীয় হাওর-বাঁওড়ের মাছের সহজলভ্যতা ছিল অতীতে। তখন প্রায় প্রতি বাড়িতেই এই পিঠা তৈরির ধুম পড়ত, পিঠা তৈরিকে কেন্দ্র করে হইচই হতো। সেই ঐতিহ্য এখনো কিছু আগ্রহী ও শৌখিন মানুষ সীমিত আকারে ধরে রাখলেও তার ব্যাপকতা আর আগের মতো নেই।

ডলু বাঁশের সাইন্টিফিক নাম হচ্ছে সচিজোস্তচ্যুড দুল্লা (গ্যাম্বলে) মজুমদার Scientificname: Schizostachyum dulloa (Gamble) Majumdar সিলেটের উত্তরাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকা এবং আসামের কাছাড়ে আদি আবাসস্থল। এটি একটি চিরসবুজ, বহুবর্ষজীবী, ছোট রাইজোম বিশিষ্ট বাঁশজাতীয় গাছ,তন্তুযুক্ত মূল ব্যবস্থা,কাণ্ডগুলি খাড়া, হেলে থাকা, অথবা অলস। ৬-৯ মিটার লম্বা, ২৫-৭৫ মিমি ব্যাস এবং ৪০-৭৫ সেমি লম্বা পাতলা দেয়ালযুক্ত ইন্টারনোড,মনোকার্পিক, ফুল ফোটার মধ্যে ১৫ বছর সময় থাকে। কান্ডগুলি সাধারণত ঝুড়ি, মাদুর এবং ছোট বাক্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলি জল বহনের পাত্র তৈরিতে, ছাতা, মাস্তুল, খুঁটি তৈরিতে এবং হালকা নির্মাণেও ব্যবহৃত হয়েছে। এটি সিলেটের মানুষদের রান্না করা একটি সুস্বাদু খাবারেও ব্যবহৃত হয় এবং কাছাড় স্থানীয়ভাবে ‘চুঙ্গা’ নামে পরিচিত। আঠালো ভাত (স্থানীয়ভাবে বিরইন চাল নামে পরিচিত) ডলু বাঁশ কেটে চুঙ্গা দিয়ে রান্না করা হয়।

লেখক-কবি, প্রভাষক শাহজাহান মানিক বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি প্রায় ঘরেই চুঙ্গা পিঠা তৈরি হতো। কিন্তু এখন সেটা চোখে কম পড়ে। তবে কত দিন টিকে থাকবে, তা বলা যাচ্ছে না। চুঙ্গা পিঠার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে ডলু বাঁশ, সেটাই দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। চুঙ্গা পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ডলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল সরবরাহ এখন অনেক কমে গেছে। অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো চাষাবাদ ও হয় না।

আরবি/জেডআর

Link copied!