খুলনার পাইকগাছা উপজেলার আধুনিক কপিলমুনির (প্রস্তাবিত বিনোদগঞ্জ পৌরসভা) রূপকার বহু প্রতিষ্ঠানের স্থপতি দানবীর রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ৯০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একদিনের বাজার বসেছে কপিলমুনির কপোতাক্ষ নদের তীরে। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার বাজারের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। তাই কপোতাক্ষ নদের তীরে একদিনের বাজার বসে। সকল শ্রেণীর মানুষ এই বাজার দেখতে ভীড় করে। আজ ১৭ জানুয়ারি, বাংলা ৩ মাঘ। আধুনিক কপিলমুনির রুপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৪১ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯০ সালের ২০ মে শুক্লাষ্টমী তিথীতে প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী সাধু খাঁ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি। তার পিতার নাম যাদব চন্দ্র সাধু, মাতা সহচরী দেবী। পিতামহ ভরত চন্দ্র সাধু, পিতামহী অমৃতময়ী দেবী।
পিতা-মাতার চার ছেলের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নানা সংকটে পড়া-লেখা বেশি দূর এগুতে না পারলেও তিনি ছিলেন জনপদের অন্যতম শিক্ষানুরাগী। জন্মস্থান কপিলমুনি থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত কিলোমিটার দ‚রে পায়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত রাড়ুলীর আর,কে,বি,কে হরিশচন্দ্র ইনষ্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন তিনি। শৈশবেই পিতার হাত ধরেই ব্যবসা জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর যৌবনে বিয়ে করেন পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। দাম্পত্য জীবনে তিনি ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। ছোট ছেলে ব্রজবিহারী সাধুর অকাল মৃত্যু হয়। অন্য ৩ ছেলে গোষ্ট বিহারী সাধু, যুমনা বিহারী সাধু ও গোলক বিহারী সাধু পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
আধুনিক কপিলমুনির রুপকার বিনোদ বিহারী সাধুর স্বর্ণালী ব্যবসা জীবনের (১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪১ সাল) ১১টি বছর কেটেছে এ কপিলমুনিতেই। ব্যবসা জীবনে যশ-প্রতিপত্তির ঘাটতি ছিলনা তাঁর। নিজ প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় ও ভরতচন্দ্র হাসপাতালের জন্য খুলনা জেলা পরিষদে তৎকালীন ৩২ হাজার টাকা রেখে যান। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির এর অর্থ যোগানে কলকাতা রিজার্ভ ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা স য় রাখেন। বাংলা ১৩৩৯ সালে কপিলমুনিতে স্থাপন করেন ‘বিনোদগজ্ঞ’। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংকের দেওয়ালে শ্বেতপাথরে লিখে যান “ভাবী বংশধর কভু না পাইবে ইহার ভবিষ্য আয়। ব্যয়িত হইবে পল্লীমঙ্গলের তরে, যে সদপ্রতিষ্ঠান পিতৃস্মৃতি রক্ষা হেতু করিনু স্থাপন, জানিব সফল মম এজনম, বিধি এ প্রানের বাসনা মোর করিলে পুরণ। আর প্রতিবেশী সদা থাকিবে সুখে, ইহার উন্নতি কামনা যদি করে অহরহ”।
বাংলা ১৩৩৮ সালের ২ কার্ত্তিক প্রতিষ্ঠা করেন সার্বজনীন বেদ মন্দির। বৃটিশ ভারতের রাজত্বে চার কোণে অবস্থিত বেদ মন্দিরের মধ্যে দক্ষিণ-প‚র্ব কোণের ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য মহা পবিত্র বেদ মন্দির এটি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। যা তৎকালীণ ব্রিটিশ সরকারেরও নজর এড়ায়নি। আর এ জন্যই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় সাহেব উপাধীতে ভুষিত করে।
নিভৃত জনপদের সমাজ উন্নয়নের এ কারিগর সৃষ্টি করে গেছেন আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ও দান করে গেছেন সর্বস্ব। বাজার প্রতিষ্ঠায় জমি খরিদপূর্বক দান, আলাদা খেলার মাঠ নির্মাণ, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় জমি দান থেকে শুরু করে নিজের বাড়িটি পর্যন্ত দান করে গেছেন জনপদের মানুষের ভাগ্যেন্নয়নে। বেরী বেরী রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩৪১ সনের আজকের দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বিষয়টি বরাবরই মাথায় ছিল তাঁর। প‚র্বপুরুষদের নামে কপিলমুনিতেই একে একে প্রতিষ্ঠা করেন বহু প্রতিষ্ঠান। যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহু কাল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপদের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ মাতার নামানুসারে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবে অমৃতময়ী টেকনিক্যাল স্কুল, লেদ, তাঁত, সুগার মেশিন স্থাপন ও দেশে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করেন। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু তৎকালীণ জনপদের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নিজ অর্থায়নে পিতামহের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ২০ শয্যা বিশিষ্ঠ ভরত চন্দ্র হাসপাতাল। যদিও কালক্রমে প্রথমত ১০ শয্যা ও বর্তমানে ফের ২০ শয্যায় উন্নিতকরণের কাজ চলছে।
প্রতিষ্ঠাকালীন বৃহত্তর খুলনা খুলনায় একমাত্র এক্স-রে মেশিনটি তিনি ভরত চন্দ্র হাসপাতালে প্রতিস্থাপন করেন। এজন্য তিনি জার্মানীতে মেশিনের অর্ডার দেন। তবে মেশিনটি দেশে আনা হলে তৎকালীন খুলনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুরোধে ১৯৩৬ সালের ৮ জানুয়ারি খুলনা সদর হাসপাতালে নিজ খরচে ভবন নির্মাণপূর্বক সেখানেই এক্স-রে মেশিনটি স্থাপন করেন।
সমাজ সেবায় তৎকালীণ সময়ে তাঁর অবদান অনস্বিকার্য। কর্মময় জীবনে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি তথা সমাজ সেবার দৃষ্টান্ত বিরল। কপিলমুনি বাজার থেকে পাশ্চাত্য প্রতাপকাটী অ লের মানুষের যাতায়াতের জন্য নাছিরপুর খালের উপর একটি কাঠের পুল (বর্তমানে ব্রীজ) নিজ অর্থে তৈরী করে ঐ পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দেন। কপোতাক্ষ নদের উপর কপিলমুনিতে নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের জন্য ঐসময় কলকাতার সেন্ট্রাল ব্যাংকে লক্ষাধিক টাকা রেখে যান। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত যার লভ্যাংশ জমা হত কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের কোষাগারে। জনস্বার্থে বাজারের মধ্যভাগে ৬/৭ বিঘা জমির উপর মায়ের নামে পুকুর খনন করে নাম দেন সহচরী সরোবর।
আপনার মতামত লিখুন :