ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

বাঁশকোঁড়ল আহরণে রাঙ্গুনিয়ায় বিলুপ্তের পথে বাঁশ শিল্প

রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৫, ০৫:১১ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজন থাকলেও অংকুরকালে বাঁশকোঁড়ল আহরণে ক্রমেই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে বাঁশের বাগান। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান সংযোগ সীমানা সংলগ্ন রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় গুলো থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ। পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত উপজাতি জনগোষ্ঠী ও সমতল ভূমি রাঙ্গুনিয়ার বাঙালি জনগোষ্ঠীর সৌখিন ভোজন রসিকদের সুস্বাদুু খাবার এখন বাঁশ কোঁড়ল। ফলে উপজেলার প্রতিটি হাট বাজার গুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ে জন্ম নেয়া কচি বাঁশের এ বাঁশকোঁড়ল। এতে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে বাঁশ উৎপাদন। ফলে প্রতি বছরের এই বর্ষা মৌসুমে রাঙ্গুনিয়ায় কয়েক কোটি বাঁশ অংকুরেই ঝরে পড়ছে, ধ্বংস হচ্ছে বাঁশের চারা, সংকটে বাঁশ সম্পদ।

জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাঁশ ব্যবসা ও বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত। বাঁশ শিল্পকে পুঁজি করে রাঙ্গুনিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতি দিনকে দিন চাঙ্গা হতে থাকে। কিন্তু বাঁশের অংকুরকালে এটাকে অনেকেই তরকারি হিসেবে ব্যবহার করায় এ ঐতিহ্যে বাঁশ শিল্প দিনদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ বাঁশ শিল্প ও ঐতিহ্য রক্ষার লক্ষে বাঁশকোঁড়ল অর্থাৎ বাঁশের অংকুর নষ্ট না করার জন্য বলা থাকলেও স্থানীয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদারকি না থাকায় বর্তমানে প্রশাসনের নাকের ডগায় উপজেলা সদরেও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। এতে দিন দিন উপজেলার বিভিন্ন পাহাড় থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে বাঁশের বংশ।

তথ্যমতে, জুন, জুলাই ও আগস্ট এ তিন মাস বাঁশ প্রজননের প্রধান সময়। এই মৌসুমে এক একটি বাঁশ গুচ্ছে ১০ থেকে ৮০টি বাঁশ গাছ একত্রে দেখা যায়। এসব গুচ্ছকে বাঁশঝাড় বলা হয়। বাঁশ দেশের মূল্যবান বনজ সম্পদ। বাঁশ মানুষের চলমান জীবনের অনন্য বস্তু হিসেবে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে। ঘর-বাড়ি নির্মাণ ও কাগজ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাবপত্র, কুটির শিল্প তৈরীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঁশের অবদান অনস্বীকার্য। এক কথায় মানুষের জীবনে বাঁশের প্রয়োজন দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। এ বাঁশকে গরিবের গজারি বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কিন্তু স্থানীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না থাকায় দিন দিন বেড়েই চলছে এই বাঁশ নিধন তৎপরতা। ক্রমেই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে বাঁশের বাগান।

এদিকে খাদ্য তালিকায় বাঁশ কোঁড়ল যোগ হওয়ায় ক্রমেই এর চাহিদা বাড়ছে। এই সুযোগে এক শ্রেণির অর্থলোভী উপজাতি ও বাঙালি বাঁশকোড়ল সংগ্রহ ও বিক্রি করাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা বাঁশের কোঁড়ল আহরণের নামে নির্বিচারে নিধন করছেন কচি বাঁশ। এভাবে কোঁড়ল আহরণের নামে বাঁশের চারা ধ্বংসের কারণে প্রতি বছর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব। এছাড়াও বাঁশের ওপর নির্ভরশীল শিল্পগুলো হারাচ্ছে কাঁচামাল।

জানা যায়, রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়গুলোতে কয়েক প্রজাতির বাঁশ জন্মে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-মুলি, দুলু, মিটিঙ্গা, কালী, পাইয়া ও ছোটিয়া। এই বাঁশকে কেন্দ্র করে উপজেলা সংলগ্ন চন্দ্রঘোনায় স্থাপিত হয় কর্ণফুলী পেপার মিল। কিন্তু বাঁশ কম উৎপাদন কারণে কাঁচামাল সংকটে পড়তে হচ্ছে কেপিএমের কাগজ উৎপাদনসহ বাঁশের ওপর নির্ভরশীল সব ধরনের শিল্প। বর্তমানে কাগজের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চাহিদানুযায়ী কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ না পাওয়ার কারণে উৎপাদনে ধস নেমে এসেছে। এছাড়াও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাঙ্গুনিয়া থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যা থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জনসহ এ কাজে অনেক লোকের কর্মসংস্থান জড়িয়ে আছে। এভাবেই চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই রাঙ্গুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বাঁশ সম্পদ।

উপজেলার রানীরহাট বাজারে বাঁশকোঁড়ল বিক্রি করতে আসা থোঁয়াই চিং মারমা বলেন, ‍‍`বাঁশকোঁড়ল এখন পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরাও পছন্দের সবজি হিসেবে খাচ্ছে। তাই পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অনেক কষ্টে এসব বাঁশকোঁড়ল সংগ্রহ করেছি। পরে বাজারে এনে প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা দরে বিক্রি করি। এভাবে দিনে ৪-৫শ টাকা ইনকাম করে কোন রকমে সংসারে খরচের জোগান দিয়ে থাকি।‍‍`

এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মাসুক করিম বলেন, ‍‍`জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস বাঁশ জন্মানোর মৌসুম। এই ৩ মাস বাঁশ কর্তন বন্ধ এবং পরিবহন করার অনুমতি দেয়া হয় না, বাঁশ কর্তন ও আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। বন বিভাগ এ সময় কাউকে বাঁশ কোঁড়ল আহরণ করতে দেয় না। অবৈধভাবে যদি কেউ করে খোঁজ খবর নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো‍‍`

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বলেন, ‍‍`জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস বাঁশের বংশবৃদ্ধি হয়। এসময় বাঁশ বাগান গুলোতে জন্ম নিতে শুরু করে নতুন বাঁশ বা বাঁশের কোঁড়ল। সাধারণত এ সময়ে বাঁশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও বাঁশকোঁড়ল আহরণ থেমে নেই। কারণ আদিকাল থেকে বাঁশকোঁড়ল পাহাড়িদের জনপ্রিয় খাদ্য। ইদানিং বাঙালিদের খাবার তালিকায় বাঁশকোঁড়ল স্থান করে নেয়ায় বাঁশ সম্পদ ঝুঁকির মধ্য পড়েছে। তবে বিষয়টি বন বিভাগের নজরে এনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেন তিনি।‍‍`

রাঙ্গুনিয়ার সচেতন মহলের ধারণা, এভাবে বাঁশকোঁড়ল আহরণ অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই রাঙ্গুনিয়ার বন থেকে বাঁশ সম্পদ একেবারেই হারিয়ে যাবে বলে।