দমন পিড়নের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়া আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় জনগুষ্ঠির জন্য বিষ ফোঁড়াই রূপ নিয়েছে। অপহরণ, মুক্তিপণ, ডাকাতি মাদক পাচারসহ এমন কোন অপরাধ নেই তারা করছেনা। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় ৬ লাখ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গারা। সচেতন মহল বলছেন ২০১৭ সালের আগে এ ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি কোন কালে ছিলনা। রোহিঙ্গা আসার পর দুএক বছর শান্তি শৃংখলা ঠিক থাকলেও গত কয়েক বছর থেকে তাদের অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কক্সবাজার জেলার সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে স্থানীয় শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার কর্মস্থলগুলো দিনের পর দিন দখল করে নিচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা। বলতে গেলে দুই উপজেলার আনাচে কানাছে রোহিঙ্গা নর-নারীদের অবাধ বিচরণ চোঁখে পড়ার মত। অথচ তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য শরণার্থী শিবিরগুলোর ভেতরে এবং বাহিরে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু রোহিঙ্গারা প্রশাসনের সদস্যদের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি দখল করে নিচ্ছে শ্রমবাজারগুলো।
এদিকে রোহিঙ্গা শ্রমিকরা কম টাকার বিনিময়ে শ্রম দেওয়ার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছে স্থানীয় শ্রমিকরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টেকনাফ উপজেলার সড়কে চলাচলকারী মোটরচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক (টমটম) এর প্রায় চালক রোহিঙ্গা। আবার হোটেল, রেস্তোরা ও চায়ের দোকানে কাজ করা কর্মচারীও রোহিঙ্গা। শ্রমবাজারের বেশীরভাগ কর্মস্থলে রোহিঙ্গা শ্রমিকদের অবস্থান।
এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী লবন চাষ, আমন ধানের চাষ থেকে শুরু করে সাগরে মৎস্য আহরণ, স্থল বন্দরের দিনমুজুরসহ প্রতিটি মৌসুমের শ্রমবাজার এখন রোহিঙ্গাদের দখলে।
গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও উঠে এসেছে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা নর-নারী স্থানীয় অর্থলোভী পরিবারের সাথে আত্মীয়তা তৈরি করে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থেকে এলাকার স্থানীয় অসাধু মালিকদের ভাড়া বাসায় বসতি স্থাপন করে মাদক, মানব পাচারসহ টাকার বিনিময়ে এমন কোন অপরাধ নেই যা তারা সংঘটিত করছে না। এতে করে উক্ত উপজেলায় সংঘটিত অপহরণ বাণিজ্য, মানুষ হত্যাসহ নানা প্রকার অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করার জন্য ক্যাম্পে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কঠোর নজরদারি অবলম্বন করার পাশাপাশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে অত্র এলাকার শ্রমবাজারগুলো রোহিঙ্গা শ্রমিকদের হাত থেকে দখল মুক্ত হবে এবং স্থানীয় অসহায় দিন মজুর শ্রমিকদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পাবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ সুশীল সমাজের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি অভিমত প্রকাশ করে বলেন, টেকনাফের স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। পর্যটনস্পট খ্যাত উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের অবাধ বিরচন প্রতিরোধ না করলে অত্র এলাকার মাদক পাচার, অপহরণ বাণিজ্য বৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি নানামুখী অপরাধ কর্মকাণ্ড বাড়তেই থাকবে। স্থানীয়দের মাঝে বসতি স্থাপন করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের আইনের আওয়তাই নিয়ে না আসলে স্থানীয় শ্রমবাজারসহ পাড়া মহল্লায় রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ বাড়তেই থাকবে। যদি এখন থেকে রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রন করা না হয়। এমন একদিন আসবে টেকনাফ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাবে বলেও অভিহিত করেছেন তারা।
শ্রমবাজার রোহিঙ্গা শ্রমিকদের দখলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে, টেকনাফ পৌরসভার বেশ কয়েকজন অর্থলোভী হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী জানান, স্থানীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে কাজ করালে তারা কাজ করে কম, টাকা চায় বেশি। আর রোহিঙ্গা শ্রমিকরা কাজ করে বেশি, টাকা নেয় কম। এই কারণে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে স্থানীয় শ্রমিকরা।
এ ছাড়াও মোটা টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা স্থানীয় কিছু অর্থলোভী মানুষের সহযোগিতায় জন্ম নিবন্ধন,জাতীয় পরিচয় পত্র বানিয়ে নিচ্ছে।
সাবরাং ইউপির পেন্ডাল পাড়া এলাকায় বসবাতরত রোহিঙ্গা জামাল হোছাইন বলেন, বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের আত্মীয় স্বজন সৌদি আরব,মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে বসবাস করে তাই মোটা টাকা দিয়ে তারা এ দেশের পরিচয় পত্র বানাতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোহিঙ্গা বলেন, আমাদের দেশে যেহেতু যেতে পারছিনা তাই আমরা এদের স্থানীয়দের ছেলে মেয়েদের সাথে বিবাহ দিই, এতে তারা আমাদের সকল কাজ সহযোগিতা করে।
সাবরাং এলাকার ডেগিল্লার বিল গ্রামে বসবাসরত পুরাতন রোহিঙ্গা গোলাম শরিফ এদেশে আসার পর তার এক ছেলে আমেরিকায় চলে যায়।পরে সে গ্রামে বিলাস বহুল বাড়ি নির্মাণ করে স্থানীয় এক লোকের মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দেয়।
স্থানীয় দিনমুজুর ওয়াজ করিম বলেন, আমার এক ছেলে দুই মেয়ে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বর্তমান সময়ে দিনমুজুরী কাজ করে সংসার চালিয়ে তাদের লেখাপড়ার খরচ বহন করা অনেক কষ্ট হচ্ছে,কারণ রোহিঙ্গা আসার আগে সরাদিন কাজ করে আমরা যে বেতন পেতাম এখন তার অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জানান, অত্র এলাকায় ঘটে যাওয়া অপহরণ, মাদক, মানব পাচারসহ নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গারা। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে-অর্থলোভী স্থানীয় ব্যক্তিরা কম টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা নর-নারীদেরকে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসাসহ নানান অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে যাচ্ছে। বেশি টাকা মুনাফার আশায় কম টাকার বিনিময়ে তাদেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে অত্র এলাকার শ্রমবাজারগুলো রোহিঙ্গা শ্রমিকদের দখলে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে হলে স্থানীয়দের মাঝে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। অপরাধীদের অবস্থান নিশ্চিত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কাছে বাসা ভাড়া দেওয়া অসাধু মালিকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো অপহরণের শিকার হয়েছে তার মধ্যে নারী পুরুষ ও শিশুও রয়েছে। সর্বশেষ গত সাপ্তাহে উখিয়া উপজেলার থাইনখালী এলাকার আব্দুর রহমানের ৬ বছরের শিশু মুহাম্মদ আরাকানকে মাটির গর্তে পুতে রেখে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণে ছেড়ে দিয়েছে। টেকনাফের হ্নীলা মুছনী এলাকায় ১৯ বনকর্মী ও বাহারছড়ার জসিম উদ্দিনকে অপহরণ করে ১৫ লাখ মুক্তিপণ আদায়সহ সকল অপহরণের নেপথ্যে অধিকাংশই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত।
রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ ও ভাড়া বাসায় এবং বিভিন্ন গ্রামে বসবাস ঠেকানো না গেলে ১২ থেকে ১৫ লাখ রোহিঙ্গাদের মাঝে দুই উপজেলার ৬ লাখ স্থানীয়দের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সকল শ্রেণী পেশার মানুষ,পাশাপাশি শ্রমবাজারও দখলমুক্ত হবেনা বলেও জানান তারা।
আপনার মতামত লিখুন :