প্রতিনিয়তই হারিয়ে যাচ্ছে পরিচিত পাখিদের ডাক৷ পাখির কলতানে ঘুম ভাঙ্গা যেন হয়ে উঠছে রূপকথার গল্প৷ আমাদের দেশে প্রতি বছরই বন্যপ্রাণী যেমন কমছে, তেমনি অতিথি পাখির সংখ্যাও কমছে।
শীতের সময় সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়, উত্তোর এশিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর নানা শীতপ্রধান দেশ থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অতিথি পাখিরা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বেঙ্গল ফোবিক্যান, সারস ও বুঁচাহাস বিলুপ্তির পথে।
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পাখির মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ মুগ্ধ করত সবাইকে। এমনকি গ্রামগঞ্জের খেড়ের চালের উপর বাসা বেধে থাকত দেশীয় পাখিরা। কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগে গ্রামগঞ্জের বাসা বাড়ি আধুনিক হচ্ছে সেই। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় পাখির আশ্রয়ের ঠিকানা।
আর যে খাবারের সন্ধানে পাখিগুলো ভোর থেকে বের হয়ে গ্রাম সবুজ মাঠের ফসলের চারদিকে ঘুরে বেড়াত কিন্তু আধুনিক যুগে সেখানে ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার, দেশীয় পাখির বিলুপ্তি অনেকাংশেই দায়ী।
কৃষকরা এখন বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে সব সময় কীটনাশক প্রয়োগ করে। এতে করে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালীসহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ মারা যায় বা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। পাখিরাও দিনের পর দিন এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে।
তাছাড়া পাখি শিকারীদের নিষ্ঠুরতা তো রয়েছেই। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড়ে পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানার মৃত্যু ঘটে ও ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পাখির বিলুপ্তি ঘটায় যেমনি জীববৈচিত্রের সংকট বাড়ছে, তেমনি আমরা হারিয়ে ফেলেছি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই আমাদের সহনশীলতা এবং সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে পাখির স্বাভাবিক বেঁচে থাকা।
সোমবার সকালে ২০ জানুয়ারি সরজমিনে রাজশাহীর চারঘাটে গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাখির কিচির মিচির ডাকে এখন আর ঘুম ভাঙেনা আমাদের। গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলছে। সবার ঘর বাড়ি মাটির ঘর থেকে দালান ঘরে নির্মাণ করছে। ফলে পাখিরা হারিয়ে ফেলছে তাদের চিরাচরিত বাসস্থান।
গ্রামের মুরুব্বিরা বলেন, আগে মাঠ-ঘাট, ক্ষেতে-খামারে বিচিত্র ধরণের পাখিদের বিচরণ ছিল। পাখিরা সে সময় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে তৃষ্ণা মেটাতো আর খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। ফসলের মাঠে পাখি বসার দৃশ্য সচরাচর দেখা গেলেও এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে।
অতীতে গ্রাম এলাকায় ব্যাপক হারে টুনটুনি, চিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, বালীহাঁস, কোকিল,বক, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, বাবুই, কাকসহ বিভিন্ন পাখিদের দেখা যেত। বর্তমানে জাতীয় পাখি দোয়েল, কাঠ ঠোকরা, কোকিল, ডাহুক, ক্যাসমেচি, বাবুই, ঘুঘু, বাওয়াই, শালিক, টুনটুনি, মাছরাঙা, বটর, টেইটেরা, গোমড়া ও প্যাচাসহ অনেক পাখিকে আর দেখা যায়না। শোনা যায় না এসব পাখির ডাক।
গ্রামবাংলার অতি পরিচিত বসন্তে যে পাখি “বউ কথা কও” বলে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে মাতিয়ে তুলতো সেই পাখির দেখাও আর পাওয়া যায়না। ফলে বর্তমান প্রজন্মরা চেনেনা এসব পাখি। এসব পাখির ডাকও শোনেনি কোনদিন। ফলে শিশু কিশোরদের কাছে দিন দিন হয়ে যাচ্ছে এসব পাখি ইতিহাস।
গ্রামের বাসিন্দা খাইরুল মিয়া বলেন, আমার বয়স এখন ৭৯ বছর, যখন আমার বয়স ১০ বছর ছিল তখন আমাদের গ্রামে কত রঙের পাখি ছিল বলে শেষ করতে পারব না। ঘরের চালের উপর পাখিরা বাসা বেঁধে থাকত। পাখির শব্দে ঘুম ভাঙত আমার। অথচ এখন আর সেই পাখিগুলো নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চারঘাট বনবিভাগের ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার মাহবুবুর বলেন, শীতের পাখি বিলুপ্তির কারণ আগের মত খাল-বিল বর্তমানে নেই তবে যে সমস্ত বিলে জলাশয় ছিলো সেগুলো এখন আর তেমন পানি দেখা যায় না। তাছাড়া ঐ সমস্ত খাল-বিলে ফসলের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করায় সেখানে আর পাখিরা বসতে পারেনা। যার কারণে অতিথি পাখির আগমন আগের তুলনায় কমে গেছে। এ ছাড়া পদ্মা নদীতে যে সমস্ত অতিথি পাখি আসে এ শ্রেণির অসাধু লোক এগুলো শিকার করছে এমন খবর পেয়ে চর এলাকায় প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের দুইটি টিম কাজ করছে। সব মিলিয়ে শীতের অতিথি পাখি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
আপনার মতামত লিখুন :