ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

বেকায়দায় সিলেট বিএনপি

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২৫, ০৮:৩১ এএম

বেকায়দায় সিলেট বিএনপি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেট জেলা বার নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থি প্রার্থীদের কাছে গণহারে বিএনপির প্রার্থীরা পরাজিত হওয়ার পর চারদিকে সমালোচনার ঝড় বইছে। দল বিএনপি ছাড়াও পুরো সিলেট এই পরাজয়ে হতবাক। 

৫ আগস্টের পর কয়েক মাসের মাথায় সিলেট জেলা বার নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি প্রার্থীরা জয়লাভ করায় দেশজুড়ে শুরু হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ প্রত্যাবর্তনের বিতর্কও। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় বিষয়টি। এর পর থেকে সিলেট বিএনপিতে শুরু হয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা। 

কেন্দ্র সিলেটকে দাঁড় করিয়েছে অভিযোগের কাঠগড়ায়। বিষয়টির প্রতি বিএনপির হাইকমান্ড বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছিল সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপিকে। গতকাল বুধবার বিকেলে তারা কেন্দ্রে চিঠির জবাবও দিয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে সিলেট বিএনপির নেতৃত্বে নেমে আসতে পারে শাস্তির খড়গ। 

অভিযোগ উঠেছে, গ্রুপিংয়ের বলি হয়েছেন দলীয় প্রার্থীরা। বিএনপির পরিচয় বহনকারী প্রার্থীদের পরিকল্পিতভাবে হারিয়েছেন দলীয় আইনজীবীরা। বিএনপি মনে করছে, বার নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হারেননি; বরং হেরে গিয়েছে বিএনপি। 

পতিত আওয়ামী লীগ যখন আন্ডারব্লকে, তখন তাদের দলের পরিচয়বহনকারী প্রার্থীদের সবাই জিতে যাওয়ায় দেশব্যাপী খোদ বিএনপিকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। দলের প্রার্থীদের হারের পেছনে সন্দেহের তীর গিয়ে ঠেকেছে সিলেট বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ওপর। বিশেষ করে জেলা বিএনপিকে দলের নেতাকর্মীরা রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন। দলীয় ফোরামসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা করেন সিলেট বিএনপির নেতৃত্বকে। 

সিলেট বারে গণহারে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ে ক্ষুব্ধ দলের কাণ্ডারি তারেক রহমানও। তিনি এর জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরই মধ্যে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ব্যর্থতার জন্য সিলেট কমিটি বাতিল করেছে। তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় তিন নেতাকে সদস্য বানিয়ে। 

সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, সিলেট জেলা বারে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ে আমরা বিব্রত। বিস্মিত। তাদের জেতাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এখানে আমাদের কোনো অবহেলা নেই। তবে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ থাকতে পারে, যার জন্য আমাদের হারতে হয়েছে। 

সিলেট বারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ময়নুল হক বুলবুলের মতে, সিলেট বারের নির্বাচনে বিএনপির বিপুল ভরাডুবি তাদের এক দিনের কর্মফল নয়। 

৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আদালতপাড়া কারা নিয়ন্ত্রণ করবে, সিলেটের রাজনীতি কারা নিয়ন্ত্রণ করবে- বিএনপির সেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এর সূত্রপাত প্রথমে রাজনৈতিক মামলা বাণিজ্য দিয়ে। তিনি এই পরাজয়ে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে বলে মন্তব্য করেন। 

তবে আদালতপাড়ার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থীরা যতটা না দলের কারণে পরাজিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি দায় তাদের নিজেদেরই। আদালতপাড়ায় বিএনপিসহ সাধারণ আইনজীবীদের কাছে তারা খুব জনপ্রিয় নন। ফলে এটি তাদের পরাজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে সিলেট জেলা বারে পিপি-জিপি নিয়োগ নিয়ে প্রথম বিতর্কের শুরু। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেটের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিনকে সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি ও জেলা বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মুজিবুর রহমানকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি নিয়োগের পর বিএনপির অপর একটি বলয় বিরোধে ফেটে পড়ে। তারা প্রথম দিনই পিপির অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। 

যেকোনো মূল্যে এ নিয়োগ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। তখন অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিনকে আটকাতে আদালতে প্রায় প্রতিদিন মহড়া ও আদালতের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। একপর্যায়ে অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিনকে ১৫ দিনের মাথায় তার নিয়োগ বাতিল করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষের অ্যাডভোকেট আশিক উদ্দিন আশুককে সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

এ সময় চলে আসে সিলেট বারের নির্বাচন। এতে সভাপতি পদপ্রার্থী হন আওয়ামীপন্থি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সরোয়ার আহমেদ চৌধুরী আবদাল। তার বিপরীতে প্রার্থী হন সিলেট বারের সাবেক সভাপতি ও বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিন। 

সাধারণ সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থী অ্যাডভোকেট জুবায়ের বখত, অ্যাডভোকেট মুমিনুর রহমান টিটু ও অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান মুননার বিপরীতে বিএনপির অ্যাডভোকেট মসরুর চৌধুরী শওকত ও অ্যাডভোকেট জহুরা ইয়াসমীন প্রার্থী হন। 

সূত্রের দাবি, এই অবস্থায় আদালতপাড়ায় অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজউদ্দিনবিরোধী বিএনপিপন্থি আইনজীবী এবং সিলেট বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা একজোট হয়ে অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিনের বিপরীতে বিএনপির সিনিয়র নেতা ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নুরুল হককে প্রার্থী করে প্রচারও শুরু করেন। 

একই সময় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্র অফিস থেকে অ্যাডভোকেট এ টি এম ফয়েজ উদ্দিনকে চিঠি ইস্যু করে অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নুরুল হককে সভাপতি পদে এবং অ্যাডভোকেট মসরুর চৌধুরী শওকতকে সাধারণ সম্পাদক পদে জাতীয়তাবাদী আইজীবী ফোরামের সমর্থনের কথা জানানো হয়। 

কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়ে কোনো ঘোষণা ছাড়া অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নুরুল হক তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। নির্বাচন হয় ১৬ জানুয়ারি। নির্বাচনে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। পূর্ণ প্যানেলে আওয়ামীপন্থি প্রার্থীরা বিজয়ী হন।


বিষয়টি দেশব্যাপী আলোচনার খোরাক জোগায়। ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে বিএনপির হাইকমান্ড। খবর পৌঁছে লন্ডনেও। এ ঘটনা বিরক্ত করে লন্ডনকেও। তারেক রহমানের নির্দেশ আসে কারণ অনুসন্ধান করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের। শোকজ দেওয়া হয় জেলা ও মহানগর বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের। এ নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েন নেতারা। 

কেন্দ্রের নির্দেশে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম রোববার সিলেট জেলা কিমিটি বাতিল করে কারণ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করে। সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক মো. জিয়াউর রহমান স্বাক্ষরিত এক পত্রে ৩ সদস্যের কমিটির কথা জানানো হয়। 

সদস্যরা হলেন-ফোরামের সহ-সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল, যুগ্ম মহাসচিব মো. কামাল হোসেন এবং সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন। তারা এ সপ্তাহে সিলেটে পৌঁছে তদন্ত করবেন।

নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের গণহারে পরাজয় ও আওয়ামী লীগপন্থিদের নিরঙ্কুশ বিজয়ে সমালোচানায় মুখর হন সিলেটের বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক মহল থেকেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। 

সারা দেশের রাজনৈতিকপাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়। বলা হচ্ছে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও নেতৃত্বের দুর্বলতা এ পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এ ঘটনার পর ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছে সিলেট বিএনপি। 

চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন শীর্ষ নেতারাও। নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। বিএনপি সূত্র জানায়, সিলেট জেলা বার নির্বাচনে সিলেটের কোনো নেতা বা জেলা ও মহানগর কারো দোষ প্রমাণিত হলে, পরাজয়ে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান জেলা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে, থাকবে। প্রশ্ন হলো- কার সাথে? 

যখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আত্মগোপনে, তখন আদালতপাড়ায় সেই আওয়ামী লীগের জয়! বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও একেবারেই স্বাভাবিক নয়। এটি আমাদের দলের ভেতরের রূপ ও চিত্র প্রকাশ করে দিয়েছে। এখান থেকে আমাদের বের হতে না পারলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের কঠিন সময় পার করতে হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!