ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫

বদলগাছীতে কৃষিজমি ও জনবসতি এলাকায় চলছে অবৈধ ইটভাটা

বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৫, ০৫:০৪ পিএম

বদলগাছীতে কৃষিজমি ও জনবসতি এলাকায় চলছে অবৈধ ইটভাটা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নওগাঁর বদলগাছীতে কৃষিজমি ও জনবসতি এলাকায় একের পর এক ইটভাটা তৈরি করে অবৈধ ভাবে চলছে। প্রশাসনের ভুমিকা নিরব। এসব ইটভাটার নেই কোন অনুমোদন, নিবন্ধন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স।

তারপরও অনুমোদন ছাড়াই চলছে এ সব ইটভাটা । ওইসব ইটভাটাগুলোর মালিকরা একটি ইটভাটা সমিতি করে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ইটভাটাগুলো চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একারনে এসব ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রশাসনের কাছে ঐসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য বারবার অভিযোগ দিলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ হয়না।

ইটভাটা পরিচালনা সমর্থক গোষ্ঠি সূত্রে জানাযায়, এলআর ফান্ডই তাদের অবৈধ ইটভাটা পরিচালনার মূল শক্তি। আর এই ফান্ড থেকে বিভিন্ন দিবসে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনকে মোটা অংকের চাঁদা প্রদান করা হয়। আবার উপজেলায় বিভিন্ন সময় যখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেও ঘর ও গুচ্ছ গ্রাম ঘর নির্মাণের সরকারি বরাদ্দ আছে তখন উপজেলার ইউএনওর কথা মতো কম দামে ইট সরবরাহ করে থাকে। তাই মাঝে-মাঝে অভিযান চলে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য। তা না হলে বছরের পর বছর এসব অবৈধ ইটভাটা আমরা চলাচ্ছি কিভাবে?

জানা যায়, বদলগাছী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে মোট ৩৪টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে একটি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকলেও আর অন্যগুলোর কোন প্রকার ইটভাটার ছাড়পত্র নেই। এবং কোনোটির জেলা প্রশাসনের লাইসেন্সও নেই। অর্থাৎ ৩৩টি ইটভাটায় এখন অবৈধভাবে ইট তৈরি করা হচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এসব অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে ঘন জন-বসতিপূর্ণ এলাকায় ২/৩ ফসলি উর্বর কৃষি জমির উপর। রাস্তা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এলজিইডি সড়ক। আবার বেশিরভাগ ইটভাটার পাশেই রয়েছে স্কুল ও ক্লিনিক। এই ইটভাটাগুলোর জন্য কৃষি জমির উপরিভাগের টপসয়েল জাতীয় মাটি কেটে ইটভাটায় আনা হচ্ছে। কিছু কিছু ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য পাহাড়ের সমান বিশাল বিশাল মাটির স্তুপ করে রেখেছে। ইতিমধ্যে দুই-চার টি ইটভাটা বাদে সব কয়টি ইটভাটায় আগুন দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। চলমান রয়েছে ইটভাটার কাজ।

এই ইটভাটাগুলোর মাত্র ১শ থেকে ২ শত গজ দুরত্বেই রয়েছে জন-বসতি ও বাড়ি-ঘর । আবার কোথাও কোথাও রয়েছে স্কুল। আর ঐ সব ইটভাটার কারনে জনবসতি এলাকার গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানে বসবাসকারী লোকজনরা।

কয়েকটি ইটভাটা সংলগ্ন বাড়ির মালিকরা জানান, ইটভাটার কারনে তাঁদের ফলজ গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাঠের ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়টি তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনকে বহুবার জানালেও। কিন্ত তাতে তাঁরা কোনো ফল পাননি।

চকগোপীনাথপুরের মাঠে নির্মিত ফাইম ইটভাটার মালিক সানোয়ার হোসেন বলেন, আমি এখানে কিছু জমি লিজ ও ক্রয় করে ইটভাটা নির্মাণ করছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন, জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স পেয়েছেন কিনা বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, না কোন অনুমতি পাইনি। তাহলে কিভাবে কৃষি জমি ও জনবসতি এলাকায় আপনি ইটভাটা নির্মাণ করে ইট পোড়াছেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর প্রদান করেননি। পাহাড়পুর ইউনিয়নের এম বি এফ ইটভাটার মালিক এনামুল হক এর কাছে ইটভাটর লাইসেন্স ও পরিবেশ এর ছাড়পত্র দেখতে চাইলে তিনি বলেন আমাদের বদলগাছীতে কারো কোন কাগজ পত্র নেই।

তাহলে আপনারা কি ভাবে ইটভাটা পরিচালনা করছেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাদের একটি ইটভাটা সমিতি রয়েছে সেই সমিতি সব ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে চাঁদা তোলে । এবং সেই টাকা দিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে। এসব দৃশ্য দেখে মনে হয় দেখার জন্য আসলেই নেই কোন কর্তৃপক্ষ । এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন না প্রশাসন। বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন সংক্রান্ত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা হয়-ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন এবং ২০১৯ সালে এটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে বলা হয়, জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত কেউ ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে কনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে তারা প্রকাশ্যে ইট প্রস্তুত অব্যাহত রেখেছেন।

পরিবেশ আইনে বলা হয়েছে, জনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি, বাজার, স্কুল, কলেজ এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। ধোঁয়াবিহীন ইট পোড়াতে হবে। কৃষি জমি থেকে কোন মাটি কেটে নেওয়া যাবে না ও এলজিডির রাস্তা ব্যবহার করা যাবেনা। এছাড়া ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার করলে রাখা হয়েছে জেল ও জরিমানার বিধান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক জন ইটভাটা মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমাদের উপজেলার প্রায় সব ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই কোন অনুমোদন, কৃষি অফিসের প্রত্যায়ন, ছাড়পত্র, নিবন্ধন ও লাইসেন্স। আমরা উপজেলা প্রশাসন সহ সব সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করেই ইটভাটাগুলো চালাচ্ছি।

বদলগাছী উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের এই উপজেলায় কারো কোন লাইসেন্স নেই। ইটভাটার মালিকরা বলছেন ইটভাটা সমিতির সভাপতি ও আপনি বিভিন্ন দিবসে প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর প্রদান না করে এই প্রতিনিধিকে বলেন আমি আপনার সাথে পরে দেখা করবো।

জানতে চাইলে বদলগাছী ইটভাটা সমিতির সভাপতি এনামুল কবির কিছুটা দাম্ভিকতার সুরে বলেন, আমরা কি ভাবে ব্যবসা করবো সেটা আমাদের বিষয়।

উপজেলা কৃষি অফিসার সাবাব ফারহান বলেন, বদলগাছীতে একটি ইটভাটাও নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি। ইটভাটার কারনে একদিকে কমছে কৃষিজমি অন্যদিকে মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের ও ফসলের। 

ইটভাটায় কৃষি জমির উপরি ভাগের মাটি কাটা বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষি জমির উপরি ভাগের টপসয়েল মাটি কাটার করনে জমির উর্বরাশক্তি কমে যায় এ কারণে সেই জমিতে তেমন কোন ফসল ভাল ফলন হয়না । ঐ জমির টপসয়েল পুরুন হতে প্রায় সময় লাগে ৮ থেকে ১০ বছর।

বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইসরাত জাহান ছনি বলেন, অমি এখানে নতুন এসেছি খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। অভিযান বিষয়ে নওগাঁ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ নাজমুল হোসাইন এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি আজকেও জেলা প্রশাসকের অফিসে আছি কোন ম্যাজিস্ট্রেট দিচ্ছে না। তাই অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না।

আপনি কি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অভিযানের জন্য বলেছেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ইউএনও সাহেবের কাছে গেলে তিনি বলেন আপনি জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে যান। তারা যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে আমরা অভিযান পরিচালনা করবো কি ভাবে। তিনি আরো বলেন বছরে আমরা ঢাকা থেকে একবার  পাই ম্যাজিস্ট্রেট তখন কিছু অভিযান পরিচালনা করি।

এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে তালিকা করে একটি রিপোর্ট দিতে বলেছি। রিপোর্ট হাতে পেলেই ঐ সব অবৈধ্য ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এলাকার সচেতন মহল বলেন, ইটভাটার কালোধোঁয়ার কারনে আমাদের পরিবেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তাঁরপরও কোন প্রশাসনই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা । এতে করে মনে হচ্ছে নাম মাএ আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু তাঁর কোন প্রয়োগ নেই বললেই চলে । তাই আমারা আমাদের এলাকায় এসব অবৈধ ইটভাটার কোলোধোঁয়া, কৃষি জমি, পরিবেশ ও মানুষকে রক্ষা করতে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর মন্ত্রনালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

আরবি/জেডআর

Link copied!