সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কের নগরে পরিণত হচ্ছে খুলনা। প্রায় প্রতি রাতেই ঘঠছে হামলা-খুনের ঘটনা। অপরাধ দমনে পুলিশের নানা উদ্যোগেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। সবশেষ শুক্রবার রাতে খুলনার তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হচ্ছে এসব হামলা। এতে চরমভাবে উদ্বিগ্ন নগরবাসী। তবে অপরাধ দমনে পুলিশের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত চার মাসে খুলনা জেলা ও মহানগরে ১১টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গুরুতর জখম হয়েছে বহু মানুষ। প্রতিটি ঘটনার পেছনে মাদক বিক্রেতা ও এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযানও চলছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার রাত সোয়া ৯টার দিকে খুলনা মহানগরের শেখপাড়া তেঁতুলতলা মোড়ে একটি মোটরসাইকেলে বসে চা পান করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী অর্ণব। এ সময় ১৫-২০টি মোটরসাইকেলে সশস্ত্র লোকজন এসে প্রথমে তাঁকে গুলি করে। গুলি তাঁর গায়ে লাগার পর রাস্তার ওপর পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে রেখে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পার্শ্ববর্তী খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
অর্ণব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের এমবিএ’র ছাত্র।
গেল সপ্তাহের সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মানিক হাওলাদারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করা হয়। বিকেলে তিনি মারা যান। সন্ধ্যা ৬টায় নগরীর আযমখান কমার্স কলেজের ভেতরে সন্ত্রাসীরা নওফেল নামে এক যুবককে কুপিয়ে তাঁর আঙুল বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর বয়রা শ্মশানঘাট এলাকায় সজীব শিকদার নামে আরেক যুবককে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।
এর আগের দিন রোববার রাতে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলিটি তাঁর ফুসফুসে আটক গেছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এমন আহতের তালিকা দীর্ঘ। এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি শনিবার রাতে নগরের মিস্ত্রিপাড়ার রসুলবাগ মসজিদের সামনে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনকে হত্যার উদ্দেশে পরপর কয়েকটি গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। একটি গুলি তার কানে বিদ্ধ হয়ে বের হয়ে গেলেও ডান বুকে বিদ্ধ হওয়া গুলিটি বের করতে পারেননি চিকিৎসকরা। তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন।
খুলনা বাসিন্দা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হঠাৎ করে শোনা যায় মারামারি-হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। বেশিরভাগ অপরাধীই মাদক ব্যবসায়ী। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে মারামারি ও খুনের ঘটনা ঘটছে। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে থাকেন। সন্ধ্যার পর বাজারে যেতেও ভয় লাগে। পুলিশ অভিযানের কথা বললেও দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বেশির ভাগ এলাকাতেই প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ মহড়া দিচ্ছে। পুলিশকে জানালেও তারা আসছে দেরি করে।
অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, খুলনায় পারস্পরিক হামলা এখন জনমনের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা মহানগরের আইনশৃঙ্খলার অবনতি সম্পর্কে খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখনো ঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। এজন্য হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মধ্যে এখন আগের মতো ভয় নেই। এতে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
তবে এ বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, মাদক বেচাকেনাসংক্রান্ত বিরোধ এবং এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা দমনে পুলিশের জোরদার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :