সিলেট মহানগরীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা। প্রতিটি পাড়া, মহল্লা ও সড়কে দল বেঁধে ঘুরছে কুকুর। দলে থাকে ১০ থেকে ১২টি। এমনকি কোথাও কোথাও ২৫ থেকে ৩০টিও দেখা যায়। এদের আচরণ হিংস্র। শিশু, নারী ও বৃদ্ধ দেখলে তারা হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক।
মাঝেমধ্যে কামড়েও দেয়। বিশেষ করে সকালবেলা নিরিবিলি সময়ে হঠাৎ কেউ রাস্তায় বেরোলে এরা আক্রমণ করে বসে। এতে গুরুতর আহত হন অনেকেই। ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে কুকুরের কামড়ে আহত হয়ে অনেককেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
নারী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কুকুরের যন্ত্রণা নিয়েই পথ চলতে হয়। সিলেটে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কুকুরের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আতঙ্ক ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
সিলেট সদর হাসপাতাল জানায়, গত তিন মাসে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছে। প্রতিনিয়ত কুকুরের কামড়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, সিলেট নগরীর বিভিন্ন রাস্তার পাশে খোলা দোকান ও রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায় অসংখ্য মানুষ। এই মানুষগুলো সহজে অসুস্থ কুকুরের সংস্পর্শে গিয়ে অসুখ ছড়াতে পারে। একইভাবে রাস্তার পাশে খোলা দোকানেও কুকুরের উৎপাত লেগে থাকে সব সময়। এসব কুকুর থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর ঝুঁকিতে রয়েছে মহানগরী সিলেট। ে
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক রূপালি বাংলাদেশকে বলেন, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা সিসিকের কাছে নেই। তবে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমরা ২০২০ সালে ২ হাজার ২০০ কুকুরকে ভ্যাকসিন দিয়েছি, সেই সংখ্যাটা মোট কুকুরের ৫০ খেকে ৬০ শতাংশ হবে।
২০১৬ সালের আগে সিলেটে কুকুর নিধন কর্মসূচি পালন করা হত। তবে আদালতের রায়ের কারণে এখন কুকুর নিধন বন্ধ আছে। দিন যত যাচ্ছে, অবস্থা ততই গুরুতর হচ্ছে, কিন্তু আমরা কোনোই ব্যবস্থা নিতে পারছি না! কুকুর উপকারী প্রাণী, কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উপকারী প্রাণী অপকারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ডা. জাহিদ বলেন, ‘ভ্যাকসিনের বাইরে আসলে এই মুহূর্তে আমাদের কিছু করার নেই। ২০১৯ সালে করা প্রাণী কল্যাণ আইনে বলা হয়েছে, মালিকানাবিহীন কোনো প্রাণী নিধন বা স্থানান্তর দণ্ডনীয় অপরাধ।
এছাড়া ২০১৪ সালে একটি প্রাণিপ্রেমী সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আদালত থেকেও। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা অসহায়।’
সিলেট ফিটনেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ এই প্রতিবেদককে বলেন, বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে নীরবতার কারণে ইদানীং ভোরে হাঁটাহাঁটি কঠিন হয়ে পড়ছে। হাঁটতে বের হলে ভয়ে থাকি, কখন বুঝি দল বেঁধে আক্রমণ করল কুকুর।
তিনি বলেন, বেওয়ারিশ কুকুর শিশু ও নারীদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে বের হলে কুকুরের উৎপাতে হাঁটা যায় না। কুকুরগুলো প্রায় সময় দল বেঁধে আক্রমণ করে। অনেক সময় তাদের টেকানো যায় না। বর্তমানে অনেকই হাঁটতে বের হলে হাতে লাঠি নিয়ে বের হন, যাতে বেওয়ারিশ কুকুর আক্রমণ করলে রক্ষা পান। ‘
সিলেট নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা জায়েদ আহমদ বলেন, একটি প্রাণিপ্রেমী সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরাও চাই না প্রাণী হত্যা করা হোক।
তবে যেসব প্রাণীর কারণে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। রাস্তায় চলাচলে আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে কার্যকর প্রদেক্ষপ গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজণনক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি।
সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মিজানুর রহমান মিয়া বলেন, বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে আমাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কেউ অসুস্থ কুকুর নিয়ে এলে আমরা তাকে চিকিৎসা দিই। এখন যে হারে বেওয়ারিশ কুকুর বাড়ছে, তাতে এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর প্রদেক্ষপ গ্রহণ করা জরুরি।
সিলেট সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নাহিদ আরজুমান বানু বলেন, সিলেট নগরীতে বেওয়ারিশ কুকুরের আতঙ্কে আছে নগরবাসী। নগরীর ব্যস্ত এলাকায় সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস। সকালে অফিসে আসার পথে প্রায়ই বেওয়ারিশ কুকুরের খপ্পরে পড়তে হয়।
মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় অনেক বেশি বেওয়ারিশ কুকুরের আনাগোনা। রাস্তায় প্রায়ই অসুস্থ কুকুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এসব কুকুর শহরে ঘুরে বেড়ায়। ফলে তাদের থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সিলেট সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (আইসিটি) ডা. মাইমুন নাহার নাসরিন বলেন, বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রম চলমান নেই। কেউ আক্রন্ত হলে সিলেট সদর হাসপাতালে ভ্যাকসিন বা চিকৎসা প্রদান করা হয়।
নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেওয়ারিশ কুকুর শিশু ও নারীদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার যেকোনো মানুষের জন্যও কুকুর নানা সমস্যা তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর দেখা যায় না। নগরবাসীর সুরক্ষার জন্য কুকুর নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সারা বিশ্বেই বেওয়ারিশ কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যাত্বকরণ কার্যক্রম চালানো হয়।
আপনার মতামত লিখুন :