চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রিয়াজউদ্দিন বাজারটি দীর্ঘকাল ধরে পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে এটি চোরাই মোবাইলের পাইকারি বাজার হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশি চোরাই মোবাইলও বিক্রি হয়।
গত বছরের ৬ জুলাই রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে ভারতীয় নাগরিক দীপান্বিতা সরকারের একটি আইফোন উদ্ধার হলে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। ওই সময়ে দীপান্বিতা জানান, তার আইফোন ১৪ প্লাসটি কলকাতার মহেশতলা থানার জিঞ্জিরা বাজার থেকে ছিনতাই হয় এবং তা ট্র্যাক করার পর তিনি দেখতে পান মোবাইলটির চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ তার ফোনটি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রিয়াজউদ্দিন বাজারে ১৫ থেকে ২০ জন ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে একটি চোরাই মোবাইল সিন্ডিকেট পরিচালিত হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভারতে নিয়মিত যাতায়াত করেন এবং সেখান থেকে চোরাই মোবাইল সংগ্রহ করে বাংলাদেশে এনে বিক্রি করেন।
এসব মোবাইল কখনো আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে, আবার কখনো পরিবর্তন না করেই বাজারে বিক্রি হয়।এই সিন্ডিকেটে ভারতীয় ও নেপালি নাগরিকরাও যুক্ত রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে মোবাইলগুলো সিলেটসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে আনা হয় এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারে বিক্রির জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন ছিনতাইকারী চক্র থেকেও চোরাই মোবাইল সংগ্রহ করা হয়।
পুলিশের কাছে এই চোরাই মোবাইল ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট তালিকা না থাকলেও বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারী ও চোরাই মোবাইলসহ ধরা পড়া ব্যক্তিদের কাছে এই ব্যবসায়ীদের নাম উঠে এসেছে।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মিশমা টেলিকমের মালিক মো. রাশেদ ও তার ভাই মো. কায়সার, কে টেল মোবাইল দোকানের মালিক আবদার উদ্দিন, মামা-ভাগ্নে সিন্ডিকেটের আলিফ ইলেকট্রনিকসের মালিক দোস্ত মোহাম্মদ মানিক ও তার ভাগ্নে মাদার টাচের মালিক খোরশেদ আলম, এন কে মোবাইলের মালিক খলিলুর রহমান, ইনোভেটিভ ফোন কেয়ার দোকানের মালিক হাবিবুল্লাহ মিজবাহ, চৌধুরী ডটকম নামের দোকানের মালিক জয় চৌধুরীর, সাহেদুল ইসলাম, মো. সোহেল রানা, ইমতিয়াজ আহম্মেদ, আরহাম মাহমুদ ওরফে নাভিল, মামুনুর রশীদ ওরফে মামুন (শাকিল)।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে চোরাই মোবাইলের ব্যবসার খবরটি আলোচনায় আসে ২০১৯ সালের জুন মাসে। সেদিন জুনের ২২ তারিখে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের রয়েল প্লাজা মার্কেটের তৃতীয় তলায় সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে মোবাইলভর্তি দুটি কার্টন উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। দুটি কার্টনে ১৬১টি ভারতীয় মোবাইল পাওয়া যায়।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ঢাকা দিলখুশা শাখার ক্যাশিয়ার সাহল খান রিয়াজ উদ্দিন বাজারের আবদার কাইয়ুম নামে একজনের নামে মোবাইলগুলো চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। পরে ডিবি পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আবদার লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগরের রফিক আহমদের ছেলে। তার আসল নাম আবদার উদ্দিন।
রিয়াজ উদ্দিন বাজারের হাসিনা হক শপিং সেন্টারে কে টেল নামে তার একটি মোবাইলের দোকান রয়েছে। পরে মোবাইলগুলো নেওয়ার জন্য তাকে ডাকা হলেও নেয়নি সে। পরে এ ঘটনায় আবদারসহ ৩ জনকে আসামি করে মামলা করে ডিবি পুলিশ।
২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নগরীর লাভলাইন এলাকা থেকে ৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে মামা-ভাগ্নে সিন্ডিকেটের নাম। পরে গ্রেপ্তার হওয়াদের স্বীকারোক্তিতে রিয়াজউদ্দিন বাজারের আলিফ ইলেকট্রনিক্স ও মাদার টাচ নামের দোকান থেকে ১৬০টি চোরাই মোবাইল উদ্ধার করা হয়।
রাশেদের মোবাইল চোরাচালানে জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসে ২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার ব্যাগ তল্লাশি করে ২২টি দামি মোবাইল, চার লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, ১৭ পিস শাড়ি, ১৭ পিস থ্রিপিস এবং ৪০ পিস টি-শার্ট জব্দ করা হয়। তার সঙ্গে ছিল (ই০০৩১১৫৪০) নম্বরের পাসপোর্ট।
সর্বশেষ, গত বুধবার রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় পুলিশের একটি অভিযান পরিচালিত হয়, যেখানে সালেহ মরিয়ম মার্কেটের ৭ম তলার একটি বাসা থেকে ৫২টি চোরাই মোবাইলসহ তিনজন গ্রেপ্তার হয়।
জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল করিম বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অভিযান চালাই এবং চোরাই মোবাইল ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি।
চোরাই মোবাইল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোকে আরো তৎপর হতে হবে। এবং দোকানগুলো চোরাই মোবাইল বেচাকেনা নিষিদ্ধ করতে হবে। চোরাই মোবাইল সিন্ডেকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান।
আপনার মতামত লিখুন :