দুই মাস আগে রবিউলের বাবা আব্দুর রহমান মারা গেছেন। ছেলেকে কারামুক্ত দেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছে ছিল রবিউলের বাবার। ইচ্ছে তো পূরণ হয়নি, উল্টো অভাব-অনটনে উন্নত চিকিৎসা হয়নি তাঁর। বাবার কথা বলতে গিয়ে রবিউলের চোখে পানি চলে আসে, বন্ধ হয়ে যায় কথা বলা।
কান্নার স্বরে রবিউল বলেন, ‘যদি দুমাস আগে কারামুক্ত হতে পারতাম, অন্তত বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হতো।’
প্রায় ১৬ বছর পর কারামুক্ত হয়ে শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) বিকেলে বাড়িতে এসে এসব কথা জানান ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার রবিউল ইসলাম। উপজেলার ভানোর ইউনিয়নের নেংটিহারা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে রবিউল। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
রবিউল ইসলাম বলেন, টানা তৃতীয়বার যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, কারাগারে সেই খবর শোনার পর আমিসহ এক সঙ্গে যতজন বিডিআর সদস্য ছিলাম সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম বাকিটা জীবন কারাগারের ভেতরেই পার করতে হবে। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়, তখন থেকে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে, কোনো দিন কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারতাম না।
রবিউল ইসলাম ১৭ বছর বয়সে বিডিআরে চাকরি পান। প্রশিক্ষণ শেষে সদর দপ্তর পিলখানায় যোগদানের ১৯ দিনের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তার চোখের সামনে। চাকরির এই ১৯ দিনে সদর দপ্তরের সবকিছুই তার কাছে অচেনা ছিল। ঘটনার দিন বিডিআর সদর দপ্তরে একটি অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে তিনিও যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ গুলির শব্দ। চারদিকে ধোঁয়া, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো সদর দপ্তর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এরপরে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। রবিউলের মতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পূর্ণ সাজানো। আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল সরকার।
আফসোস করে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘কারাগারে জীবনের সবচেয়ে গোল্ডেন সময় শেষ হয়ে গেছে। চাকরি পাওয়ার পর মনে করেছিলাম বাবা-মায়ের পাশে থাকবো। অনেক কষ্ট করেছেন মা-বাবা। আর কোনো কষ্ট করতে দেব না। কিন্তু উল্টো তাদের বোঝা হয়ে পড়েছিলাম। প্রতি মাসে কারাগারে খাওয়া খরচ ও ছয় মাস পর-পর কাপড় চোপড় কেনার পয়সা নিতে হয়েছে। পিলখানার এই ঘটনা না ঘটলে এত দিনে বিয়ে করতে পারতাম, বাচ্চা হতো। বাবা-মা তাদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলা করত। এখন চাইলেও জীবনের সেই মুহূর্ত ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’
আমাকে কারামুক্তের চেষ্টা ও আমার ভরণ-পোষণ জোগাড় করতে গিয়ে আমার বড় ভাই শাহাজাহান আলীও তাঁর জীবনের ১৬ বছর ব্যয় করেছেন। স্ত্রী-সন্তানকে রেখে আমার জন্য ঢাকায় ছুটে গিয়েছেন প্রতি মাসে। কখনো কারাগারে, কখনো আদালতের বারান্দায়। সব মিলিয়ে আমরা নিঃস্ব দুই ভাই। ১৬ বছর এমন করুণ পরিণতির জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করছেন রবিউল ইসলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তিনিসহ তাঁর সব নির্দোষ সহকর্মীদের মুক্তি এবং চাকরিতে পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে ছেলেকে ১৬ বছর পর বাড়িতে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা মা সালেহা খাতুন। স্বামীর মৃত্যু ও ছেলে কারাগারে থাকার দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়া শরীর যেন পুরোপুরি সুস্থ তাঁর। সালেহা খাতুন বলেন, ‘মোর বাপজান মুক্তি পাইজে, মোর বাড়িত ফিরে অসিজে। মোর আইজ খুব আনন্দ, ১৬ বছরে ৩২টা ঈদ গেইজে, কুনোদিন এক চামচ সেমাই, একখান টুকরা গোশতোও মুখে দুনি। এবার মোর বেটাক লে ঈদত একসঙ্গে বসে সেমাই খাম, গোশতো খাম। মি খুব খুশি, ড. ইউনূস সরকারকে ধন্যবাদ।’
রবিউল ফেরার খবরে একনজর দেখার জন্য তাঁর বাড়িতে ছুটে এসে প্রতিবেশী আইনজীবী বাবুল ইসলাম বলেন, রবিউলের মতো যত নির্দোষ সাবেক বিডিআর সদস্য রয়েছেন, সরকারের উচিত তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। না হলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে রবিউলরা কী করবেন, সামনে তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
বড় ভাই শাহাজাহান আলী বলেন, ‘বাবা ও মাকে কথা দিয়েছিলাম ভাইকে কারামুক্ত করব, তাদের কোলে ফিরিয়ে দেব। ভাই কারামুক্ত হলেও বাবা নেই। বাবা থাকলে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতো। অনেক হয়রানি, খরচ হলেও ভাইকে ফিরে পেয়ে খুশি।’
আপনার মতামত লিখুন :