ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনকে ঘিরে জেলা জুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই বার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও দুই বারই স্থগিত করা হয়েছে। চারদিকে সমালোচনার ঝড় বইছে সম্মেলনকে ঘিরে। এক দল সম্মেলন সফলের চেষ্টা আরেক দল ঠেকানোর জন্য চেষ্টা। এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ও ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এক পক্ষ সম্মেলনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও অপর পক্ষের বিরোধিতার জেরে দুটি তারিখই পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। গত ২২ জানুয়ারি সম্মেলনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আ.জ.ম মোরশেদ আল মামুন স্বাক্ষরিত জেলা বিএনপির দলীয় প্যাডে গণবিজ্ঞপ্তিতে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়।
সম্মেলন নিয়ে নানান ধরনের বিতর্ক ও পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করেই যাচ্ছে দু’পক্ষ। এক পক্ষ সম্মেলন সফল করার লক্ষে জেলা শহর ও উপজেলাতে সম্মেলন পূর্বপ্রস্তুতির গণসমাবেশ করছেন। অন্য আরেক পক্ষ সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পাল্টা গণসমাবেশ, র্যালি ও বিক্ষোভ মিছিল করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের মনে এক ভয়ংকর আতংক বিরাজ করছে। সারাজেলা জুড়ে রাজনৈতিকপাড়ায় মাহবুব শ্যামল গ্রুপ ও কবির ভূইয়া গ্রুপ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
বলা হচ্ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও নেতৃত্বের দুর্বলতা এ জটিলতার অন্যতম কারণ। এ ঘটনার পর ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি। সম্মেলন নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন শীর্ষ নেতারাও। স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দু’গ্রুপের নেতাকর্মীদের। সম্মেলনের বিরোধীতা প্রতিহতের ঘোষণা দেওয়াতে গত (১৩ জানুয়ারি) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় এক পক্ষের নেতাকর্মীদের। কারণ জানাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লিখিত জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আরেক পক্ষ সম্মেলন সফল করার লক্ষে অনুমতি ছাড়াই স্থান দিয়েছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে। সম্মেলন বন্ধের জন্য পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানী লিমিটেড (বিজিএফসিএল) কর্তৃপক্ষ।
গত ২২ জানুয়ারি সম্মেলনের নতুন তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করার পর থেকে আবারো জেলা জুড়ে নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও মিছিল বের করছেন দু’গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এক গ্রুপের সম্মেলন প্রস্তুতি র্যালি মিছিল বের হলে অন্য গ্রুপ সম্মেলন প্রতিহত ঘোষণা দিয়ে মিছিল বের করে। গত ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল নিয়ে বিশাল মিছিল বের করেন সম্মেলন বন্ধের দাবিতে।
জেলা বিএনপির একাংশের দাবি কবির আহমেদ ভূঁইয়া ও তার অনুসারীরা মিলে ১ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির মূল ধারাকে পাশ কাটিয়ে এ সম্মেলন দেওয়া হয়েছে। তারা এ সম্মেলন প্রতিরোধ করবেন। যাকে নিয়ে আজকে এ সম্মেলনের আয়োজন চলছে, সেই কবির ভূঁইয়া ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। আজকে তিনি জেলা বিএনপির সভাপতি হতে চান। তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেওয়া হবে না। ১ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন তাদের কর্মসূচি চলতে থাকবে।
জানা গেছে, গত ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট জেলা বিএনপির ৫ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর পর থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের জেরে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মান্নান, সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি পক্ষ এবং আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি সাবেক পৌর মেয়র হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি এবং সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খোকনের নেতৃত্বে আরেকটি বড় অংশ রয়েছে।
গত প্রায় দুই বছর ধরেই উভয়পক্ষ পৃথকভাবে দলীয় সব কর্মসূচি পালন করে আসছে। নেতাকর্মীদের বিরোধ দূর না করেই গত বছরের ২ নভেম্বর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিএনপির ফেসবুক পেজে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জেলা বিএনপির ৩২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে।
এতে আগের পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলকে ১ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। আগের কমিটির ২,৩ ও ৪ নম্বর সদস্য জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক ও নূরে আলম সিদ্দিকীকে নতুন কমিটিতে যথাক্রমে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। কমিটিতে কবির আহমেদ ভূঁইয়াকে ৩২ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। কবির আহমেদ ভূঁইয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই এবং আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে দলীয় প্রার্থী হতে চান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতা জানান, ৩২ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান পাওয়া ২৬ নেতাই কবির আহমেদ ভূঁইয়ার অনুসারী। বাকি চারজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে একাধিকবার প্রার্থী হওয়া খালেদ হোসেনের অনুসারী। খালেদ হোসেনের অনুসারীদের কমিটিতে না রাখায় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি বলেন, এ সম্মেলন নিয়ম বহির্ভূত সম্মেলন। সম্মেলনে যে ভোটার তালিকা করা হয়েছে তা সঠিক না। নিত্যদিনে যারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছে। তারা অবৈধভাবে ভোটার তালিকা করেছে। এখনও ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তাদের মনগড়া সম্মেলন করেছে। আমরা আহবান করেছি সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি করে তারপর সম্মেলন অনুষ্ঠিত করা হোক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে কিন্তু তারা কার ভয়ে কিসের ভয়ে তাদের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে না। এখানে কোন শক্তি কাজ করছে সেটাই প্রশ্ন।
সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল মান্নান বলেন, এই মুহুর্তে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না সাথে অনেক লোকজন আছে। পরবর্তীতে যোগাযোগ রাখতে হবে এখন লোকজন আছে।
সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমি দলের দুর্সময়ে দলের জন্য কাজ করেছি। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে আমি তা আগেও মেনে রাজনীতি করেছি ভবিষ্যতেও করব। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন যারা ভয়ে মুখ খুলেনি তারাই আজকে আমার নামে বিভিন্ন অপপ্রচার করছে।ফেসবুকে ছাত্রলীগের একটি কমেটির তালিকা প্রচার করে আমার নামে চালিয়া দিচ্ছে যা আমার নামের সাথে মিল নেই এবং সেটা আমি না। আমি কুমিল্লা ভিক্টিরিয়া কলেজে ছাত্রদলের রাজনীতি করেছি। যাদের সাথে করেছি তারাই বলতে পারবে।
দলের প্রয়োজনে ও দলের দুর্সময়ে আমি কাজ করেছি। অনেক গণমাধ্যমকর্মী না জেনেই লিখালিখি করছে। গণমাধ্যমকর্মীদের অনুরোধ করব যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে এবং উন্নয়ন করে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করব।
আপনার মতামত লিখুন :