ঢাকা শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫

মেঘনা-গোমতীর আতঙ্ক জলদস্যু জিতু বাহিনী

মোঃ খায়রুল ইসলাম হৃদয়, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ০৭:৪২ পিএম

মেঘনা-গোমতীর আতঙ্ক জলদস্যু জিতু বাহিনী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা ও গোমতির নদী পথের আতঙ্ক জলদস্যু জিতু রাঢ়ী ও তার বাহিনীর সদস্যরা। দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সুযোগে জিতু রাঢ়ী ও তার সহযোগীদের নিয়ে দীর্ঘ২৫ কিলোমিটার নৌপথ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চালাচ্ছে অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসা।নৌযানে ডাকাতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে নতুন করে।

জানা গেছে, এ জলদস্যু জিতু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে গৃহবধূ মমতাজ বেগম হত্যা, চাঞ্চল্যকর হালিম হত্যা, কিশোর সাগর হত্যা, র‍্যাবের সাথে গোলাগুলি,ভোট কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স লুট, শ্যালকের স্ত্রীকে জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা, চাঁদাবাজিসহ প্রায় ২৮/৩০ টি মামলা থাকলেও স্ব স্ব দাপটে বহাল তবিয়তে জল ও স্থল পথ দাবড়ে বেড়াচ্ছে জলদস্যু জিতু রাঢ়ী ও তার বাহিনী।

আরো জানা যায়, ২০১১ সালে সংঘটিত হালিম হত্যা মামলা তুলে নিতে বাদী মিনু বেগম ও স্বাক্ষী হারুন সরকারকে প্রতিনিয়ত মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে জলদস্যু জিতু রাঢ়ী। এ কারনে প্রাণ ভয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামছাড়া হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে হত্যা মামলার স্বাক্ষী যুবদল কর্মী হারুন সরকার। এ বিষয়টি তুলে ধরে হত্যাসহ প্রায় ২৯ মামলার আসামী জিতু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ৩ অক্টোবর বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত আবেদন করলেও বিগতর এ ৪ মাসের মধ্যে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি প্রশাসন থেকে। এই সুযোগে জলদস্যু জিতু বাহিনী সক্রিয় হয়ে স্থল ও জল পথে একসঙ্গে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন যুগ ধরে বাহিনীর প্রধান জলদস্যু জিতু রাঢ়ী ও তার দলের সদস্যরা গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া,পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ, চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকাধীন মেঘনা ও গোমতী নদীতে ডাকাতি, হত্যা, যাত্রীবাহী নৌযানে ডাকাতি, বালু ও মাটি বহনকারী বাল্কহেড এবং মাছের ট্রলার থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মেঘনা ও গোমতী নদী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, চাঁদপুরের মতলব উত্তর, কুমিল্লার দাউদকান্দি ও নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও সীমানা ঘেঁষা হওয়ায় নদী পথে সংঘটিত অপরাধ কর্মকান্ডের দায়-ভার নিতে চায় না কোনো জেলার থানা পুলিশ। আর এ সুযোগে জলদস্যু জিতু বাহিনী মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়ার মেঘনা ও কুমিলার দাউদকান্দির গোমতী নদীতে গড়ে তুলেছে অপরাধের বিশাল রাজ্যত্ব।ফলো জিতু বাহিনীর অত্যাচারে জিম্মি হয়ে পড়েছে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় উপজেলার সহ আশেপাশে জেলার হাজার হাজার মানুষ।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের নাকের ডগায় দিনের পর দিন অসংখ্য অপরাধ কমর্কান্ড চালালেও জলদস্যু জিতু রাঢ়ী ও তার সহযোগীরা রয়ে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

স্থানীয় গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগী সূত্র জানায়, নব্বই দশকের শুরুর দিকে জেলার গজারিয়া উপজেলার নদী বেষ্টিত গুয়াগাছিয়া এলাকার মৃত হাফেজ রাঢ়ীর ছেলে জিতু রাঢ়ী, তার ভাতিজা, চাচাতো ভাই গেসু, ছলি ও রেনুসহ কিছু নিকট আত্নীয় নিয়ে গড়ে তুলে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর শুরু হয় তাদের নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড।

স্থানীয় গ্রামবাসী আরও জানায়, নৌপথে ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন রাহজানিসহ অপরাধ কর্মকান্ডের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় জায়গা করে নেয় জলদস্যু বাহিনীর প্রধান জিতু ও তার দলের সদস্যরা। জিতু ও তার বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার পুলিশ ও র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়। জেল থেকে বের হয়ে আবারও শুরু করে একই কর্মকাণ্ড। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় জলদস্যু জিতু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে জলদস্যু জিতু রাঢ়ী আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি মৃণাল কান্তি দাসের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠে জিতু ও তার বাহিনী। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আলোচিত হালিম হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী তৎকালীন গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি হারুন সরকারের ওপর হামলা করে তার ডান পা কেটে নেয় ডাকাত সরদার জিতু ও তার বাহিনী।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ গজারিয়ার মেঘনা নদীতে ডাকাতি করতে গিয়ে জলদস্যু জিতু ও তার বাহিনী মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার ১৪ বছরের এতিম কিশোর সাগরকে হত্যা করে । ট্রলার যোগে মতলব থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়ে প্রান হারায় সাগর। এ ঘটনায় নিহতের দুলাভাই মহসিন মিয়া বাদী হয়ে জলদস্যু জিতুকে প্রধান আসামী করে গজারিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে।

২০১১ সালের ২৪ মার্চ গভীর রাতে জলদস্যু জিতু ও তার বাহিনী ঘরে ঢুকে আমেরিকা প্রবাসী গৃহবধু মমতাজ বেগমকে (৫৫) খুন করে ঘরে রক্ষিত স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুটে নেয়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় জিতুর ভাই।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর ৩১ মার্চ মতলব উত্তর বেলতলী লঞ্চঘাট থেকে দাবীকৃত চাঁদার টাকা না দেয়ায় দোকান থেকে ডেকে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের যুবক হালিমকে হত্যা করে জলদস্যুরা। এ ঘটনায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানায় জলদস্যু জিতুকে প্রধান আসামী করে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে নিহতের মা মিনু বেগম।

২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁও এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি করার সময় র‍্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় জলদস্যু জিতুর ভাতিজা দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ফয়েজ। এ ব্যাপারে র‍্যাব বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় ডাকাতি মামলা দায়ের করে।

২০০৯ সালের ২৮ মে রাতে গোমতি নদীর গুয়াগাছিয়ার বসুরচর এলাকায় জলদস্রু জিতু ও তার বাহিনী ডাকাতি করার প্রস্তুতিকালে র‍্যাবের সাথে গোলাগুলি হয়। গোলগুলি শেষে র‍্যাব জলদস্যু জিতুর দুই ভাই অলি ও কলিমউদ্দিনকে অস্ত্রসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে। এ ব্যাপারে র‍্যাব বাদী হয়ে গজারিয়া থানায় মামলা দায়ের করে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে জলদস্যু জিতু রাঢ়ীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গজারিয়া থানায় ওসি মো.আনোয়ার আলম আজাদ বলেন, নৌ ডাকাত ও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে পুলিশ। বাহিনীর প্রধান জিতু রাঢ়ী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে। শিগগিরই জলদস্যু জিতু রাঢ়ীকে আইনের আওতায় নেওয়া সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে নৌ ডাকাত ও জলদস্যুদের অপরাধ কর্মকাণ্ড রোধে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!