২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিষ্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ১৬ বছর পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তৎকালীন বিডিআরের ল্যান্স কর্পোরাল ফজলুর রহমান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাড়িতে ফিরে স্ত্রী ও স্বজনদের কাছে পেয়ে অঝোড়ে কাঁদলেন তিনি। এ সময় তাকে দেখতে ভিড় জমান পাড়া প্রতিবেশী ও স্বজনরা। তাকে দেখতে আসা স্থানীয় লোকজন ফজলুরের পূনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
দীর্ঘ ১৬ বছর কারাগারে থাকাকালীন সময়ে মা-বাবা, বোনসহ ৯ জন নিকট আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছেন তিনি। এসব আত্মীয়-স্বজন মারা গেলেও এক নজর দেখা কিংবা জানাজায় অংশ নেয়ারও সুযোগ ছিলো না তার। কারাগারে দেখা করার তেমন সুযোগ হয়নি পরিবারের সদস্যদেরও। কারাগারে থেকে এতগুলো স্বজন হারানোর খবরও দেয়নি কেউ। তাই বাড়িতে এসে তাদের দেখতে না পেয়ে হতবিহব্বল হয়ে পড়েছেন ফজলুর।
এখন মুক্ত হলেও ফজলুর রহমান কিছুটা মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছে তার। ৭ ভাই-বোনের মধ্যে ফজলুর ৩য়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মুক্ত বাতাসে স্বামীকে ফিরে পেয়েও স্বামীর শারীরীক অবস্থা আর চাকুরী না থাকায় সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে এ নিয়ে শঙ্কায় তার স্ত্রী।
ফজলুর রহমান কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নের ধাউরারকুঠি গ্রামের মৃত শাহার আলীর ছেলে। দেশ সেবার ব্রত নিয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ রাইফেলসে। যৌবনের দিনগুলো কেটেছে দেশের সীমান্ত রক্ষায় চৌকশ সিপাহি হিসেবে। সিপাহি থেকে ল্যান্সনায়েক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন তিনি। তার কর্মস্থল বিডিআর হেডকোয়র্টার পিলখানায় থাকায় ফেঁসে যায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী ঘটে যাওয়া বিডিয়ার হত্যাকান্ডের ঘটনার বিষ্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায়। প্রহসনের বিচারে ১৬ বছর কারাভোগ করে সদ্য জামিন পান তিনি। গত ২৩ জানুয়ারী কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ২৪ জানুয়ারী তার নিজ বাড়িতে ফেরেন তিনি। এ সময় এক হৃদয় বিদারক ঘটনা সৃষ্টি হয়। দলে দলে তাকে দেখতে আসে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গ্রামবাসী।
কারাভোগের ১৬ বছরে তিনি হারিয়েছেন প্রিয় মা-বাবা, বোনসহ ৯ জন নিকট আত্মীয়। বিনা দোষে জেল, প্রিয়জনদের হারিয়ে মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। অনেকে তার সাথে দেখা করতে আসলে নির্বাক তাকিয়ে থাকছেন তিনি। দীর্ঘ ১৬ বছর অপেক্ষার পর স্বামীকে কাছে পেয়েও দুশ্চিন্তা কাটছে না স্ত্রী রাশেদা খাতুনের। ১৬ বছর অসহনিয় দুঃখ, কষ্ট আর গ্লানি নিয়ে চলতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। এমনকি কারাগারে দেখতে পর্যন্ত যেতে পারেননি তারা।
আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রাশেদা।
এ সময় তিনি বলেন, ১৬টি বছর সমাজের নানা সমালোচনা সহ্য করে খেয়ে না খেয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছি। নিজের সন্তান না থাকায় ননদের সন্তানকে নিয়ে মানুষ করেছে। ছোট থেকেই সেই মেয়ে তার বাবাকে (ফজলুর রহমান) খুজেছে, আমি কোন উত্তর দিতে পারি নাই। এখন স্বামী ফিরে আসলেও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। অনেককে চিনতে পারছে আবার অনেককে চিনতে পারছে না। আবোল তাবল বলছে। আমি এখন কি করবো, কোথায় যাবো।
ফজলুর রহমানের বড় ভাই ছামাদ আলী বলেন, সংসারে অভাব অনটন থাকায় ফজলুর রহমানের লেখা পড়া বন্ধ করে বিডআরে পাঠাই। সে খুব ভালো ছিলো, ছোট দুই ভাইকে তার অনুপ্রেরণায় সেনাবাহীনিতে দেই। ফজলুর রহমান দেশের জন্য কাজ করেছে। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনাই। ১৬ বছর ভাই কারাগারে ছিলো আমরা তাকে দেখতে পর্যন্ত যেতে পারি নাই। মানুষ আমাদের ঘৃণার চোখে দেখেছে। এই কয়েক বছরে আমাদের বাবা- মা, এক বোনসহ ৯ জন নিকট আত্মীয় মারা গেছে, ও দেখতে পারে নাই।
ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ইউসুফ আলী বলেন, বড় ভাই ফজলুর রহমানের অনুপ্রেণার আমরা দুই ভাই সেনাবাহীনিতে যোগ দেই। সেই পরিবারের সদস্য হয়েও আমার ভাইকে বিনা দোষে ১৬ বছর কারাভোগ করতে হলো। ১৯ তারিখের যে জাজমেন্ট ছিলো সেটাতে আমরা খুশি। আমাদের ভাইকে ফিরে পেয়েছি। তবে ভাইয়ের চাকরি নাই। এখন অসুস্থ্য। কিভাবে তার সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। সরকারের কাছে তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানাই।
স্থানীয় আনিছুরর রহমান ও তাসলিমা খাতুন জানান, ১৬ বছর এই পরিবারের উপর দিয়ে অনেক দুঃখ কষ্ট গেছে। এখন ফজলুর ভাই ফিরে আসলেও রোগে শোকে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা দরকার।সরকারকে তার চিকিৎসা এবং পূনর্বাসন করতে হবে।
ফজলুর রহমান বলেন, এ মামলার সাথে কোন সংশ্লিষ্ঠতা ছিলো না বলে মুক্ত হয়েছেন তিনি। ১৬ বছরে বাবা- মা, বোন মারা গেছেন, ২ ফুফু মারা গেছেন, জ্যাঠা-মামাসহ আরোও কয়েকজন নিকট আত্মীয় মারা গেছেন, তাদেরও দেখতে পারি নাই। তাদের তো আর ফিরে পাব না। তাদের না দেখার কষ্ট নিয়েই থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমার চাকুরীটাই ছিলো একমাত্র সম্বল। এখন তো চাকরিটাও নেই। সরকারের কাছে দাবী আমাদের পূনর্বাসন করুক। সরকার চাইলে এটা করতে পারে। পূনর্বাসন হলে আমার আর চাওয়ার কিছু নাই।
আপনার মতামত লিখুন :