ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

পানিশূন্য তিস্তার বুকে সবুজ ফসলের সমারোহ

কালীগঞ্জ (লালমনিরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ০৮:৫৭ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

লালমনিরহাটে চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়া তিস্তা নদীর বুকে জেগে উঠেছে শতাধিক চর। মরুভূমির মতো সাদা বালুতে ফসল ফলাচ্ছেন কৃষকেরা। ২০২৪ সালে কয়েক দফা বন্যার পানিতে উজান থেকে ভেসে আসা পলি মাটি বালুতে পরে চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছে এসব চরাঞ্চল। বন্যা ও নদী ভাঙনের ক্ষতি কাটিয়ে পলিযুক্ত সাদা বালুর চরে এখন চাষ হচ্ছে বাদাম, আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, তামাক, রসুন, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়াসহ অর্থকরী ফসলগুলো।

নদীতে পানি না থাকায় ডিজেলচালিত পানির পাম্প (শ্যালো) বসিয়ে সেচের পানি সংগ্রহ করে চাষাবাদ করছেন চাষিরা। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা ধুধু বালু চরে কৃষকের এই সেচনির্ভর চাষাবাদে ফসল উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে করে বাড়তি খরচে দুশ্চিন্তায় কৃষক।

স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিস্তার এই চরগুলোতে গ্রামের দামি জমির চেয়েও ফলন বেশি। জমিহীন বর্গা চাষিরা গ্রামের জমির চেয়ে কম দামে চরের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। ১৫ থেকে ২০ ফিট মাটি খুঁড়লেই সেচের পানির ব্যবস্থা করতে পারছেন বলে জানান তারা। তবে বর্গাচাষি বেশিরভাগ কৃষকেরই সেই সামর্থ্য নেই।

[32179]

গত বছর ভারতের সিকিমের চুংথাং বাঁধ ভেঙে একদিনে ভেসে যায় তিস্তা। তখন দুর্গতির সীমা ছিল না। কিন্তু এখন তিস্তাপাড়ের মানুষ খুশি। ওই বন্যায় স্মরণকালের সব থেকে ঘোলাটে পানি আসে। পানি কমে গিয়ে তিস্তার চকচকে বালির ওপর ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত পলি জমেছে। আর এই পলিযুক্ত বালিতে অল্প সার ও পানি ব্যবহার করেই কৃষকরা ফসল ফলাচ্ছেন।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তিস্তায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি আছে। প্রতিনিয়ত নতুন চরকে চাষযোগ্য করা হচ্ছে। যেখানে শুধু বালি আছে সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা করে চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। রবিশস্য, ধান, পাট, আলু, বাদাম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মরিচ, ডাল এসব অর্থকরী ফসল চরাঞ্চলেই বেশি উৎপাদন হয়। জেলার হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদরের তিস্তার চরে সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হচ্ছে।

জানা যায়, সেচের অভাবে জেগে ওঠা চরের বৃহৎ অংশই চাষাবাদের বাইরে রয়েছে। এদিকে নদীতে পানি সংকট থাকায় চাষাবাদকৃত জমিতে কৃষকরা শ্যালো ইঞ্জিন ব্যবহার করে সেচ কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

মরুভূমির মতো সাদা বালুতে সেচের মাধ্যমে পানি দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারো শুকিয়ে যায়। তিস্তা খনন করে স্থায়ী প্রবাহমান পানির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। তিস্তায় পানি থাকলে সোনালি ফসল ফলাতে তাদের কোনো বেগ পেতে হতো না। নতুন জেগে ওঠা হাজার হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের উপযোগী হতো। পানি না থাকায় তাদের এখন মরণদশা। ডিজেল কিনে ফসল ফলাতে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের কৃষক মাহতাব আলী বলেন, তিস্তা সড়ক সেতুর পাশে তিস্তা নদীর বুকে ধুধু বালুচরে আলু ও লাল শাক চাষ করেছেন। আলু খেতের পানির দরকার হওয়ায় তিনি নদীর বুকে শ্যালো মেশিন বসিয়েছেন। সেচ পদ্ধতির বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, কয়েকজন কৃষক মিলে আমরা একটি শ্যালো মেশিন থেকে সেচের পানি সংগ্রহ করে ধুধু বালু চরে চাষাবাদ করছি।

[32177]

কালীগঞ্জের রুদ্রেশ্বর চর এলাকার কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, তিস্তার পানি নেমে যাওয়ার পর জেগে ওঠা চরে নানা জাতের ফসল চাষ হয়। এবছর আমি ৫ একর জমিতে আগাম ভুট্টা লাগিয়েছি। চরের এসব জমিতে ভুট্টার ফলন অন্যান্য জমির চেয়ে অনেক বেশি। ধানের চেয়ে ফলন বেশি ও দাম দ্বিগুণ হওয়ায় লাভবান হবেন বলে তিনি আশা করছেন।

চর অধ্যুষিত ভোটমারী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, অনাবাদি পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করার লক্ষ্যে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সহযোগিতায় কৃষকদের চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছি চরাঞ্চলের কৃষকদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইখুল আরিফিন বলেন, জেলায় তিস্তা ও ধরলা নদীর বিশাল চরাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার কৃষক বালুচরে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছেন। আলু, ভূট্টা ও মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদ করে চরের কৃষকরা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। সেচের জন্য ব্যয় কিছুটা বাড়লেও কীটনাশকের ব্যয় চরের চাষাবাদে কম লাগে। তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ থাকলে তারা সেখান থেকে সেচের পানি সরবরাহ করে ফসল উৎপাদনে খরচ কমাতে পারতেন। আমরা কৃষি বিভাগ থেকে চরের কৃষকদের বালুচরে নানা ফসল উৎপাদনে কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে আসছি।