বহু অঘটন পটিয়সী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রগুলোতে মোটা দাগে শিরোনাম হচ্ছে।
সবশেষ গত ১৭ জানুয়ারি প্রকাশ পায় আওয়ামীপন্থি রাজনীতিক ডিএসসিসির সাবেক মেয়র তাপসের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংক সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী আমানত ফেরত দিতে গড়িমসি করছে। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে একাধিকবার লিখিত ও মৌখিক তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো কর্ণপাত করছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের মামলার হুমকি-ধমকি ও তুমুল বিতর্কের মধ্যেই তাপসের মধুমতির আরেকটি কেলেংকারি প্রকাশ্যে এসেছে। খোদ বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মার্কেটে ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালিত হলেও দেড় বছর ধরে এক পয়সাও ভাড়া দেয়নি। এমনকি চুক্তি অনুযায়ী অগ্রিম টাকা দেওয়ার কথা থাকলে তাও পরিশোধ করেনি; যা নিয়ে বরিশালের রাজনৈতিক, সুশীল ও প্রশাসনিক মহলে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে।
নগর ভবন সূত্র নিশ্চিত করেছে, সিটি করপোরেশনের মালিকাধীন সিটি সুপার মার্কেটের নতুন ভবন নির্মাণের আগে সেখানে ২৯টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। পুরোপুরি নির্মাণের পর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদের ফ্লোর বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে ঠিকাদার ও বরাদ্দ জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের ৫ বছর পার হলেও ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এই লেজেগোবরে অবস্থার মধ্যেই প্রকাশ্যে এলো আওয়ামীপন্থি রাজনীতিক ফজলে নূর তাপসের ব্যাংকের কেলেংকারি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, তাদের মালিকাধীন সিটি সুপার মার্কেটের বড় একটি অংশ শেখ পরিবারের সন্তান তাপসের মধুমতি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভাড়া নেয়। ওই সময় বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, যিনি বিতর্কিত রাজনৈতিক তাপসের সম্পর্কে মামাতো ভাই।
বিসিসি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বরিশাল নগরীর সদর রোডের সাততলা সিটি সুপার মার্কেটের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ১ হাজার ৯৩০ বর্গফুট ফ্লোর ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে মধুমতি ব্যাংক। মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা এবং শর্তাবলি অনুযায়ী, দুই বছরের অগ্রিম ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অগ্রিম ভাড়া তো দূরের কথা, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ মাসে এক টাকাও ভাড়া পরিশোধ করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সূত্রটি জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মার্কেটে বিনা ভাড়ায় তাপসের ব্যাংক পরিচালনার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
জানা গেছে, ১৭ মাসের ভাড়াসহ শর্ত অনুযায়ী দুই বছরের অগ্রিম টাকা চেয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন একাধিকবার নোটিশ দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে সবশেষে ভাড়া পরিশোধসহ ভবন ছেড়ে দিতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বিসিসি।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সারথী তাপসের মধুমতি ব্যাংকের কাছে ভবনটি তৎকালীন বিতর্কিত মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে ভাড়া দেন। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা মুখ না খুললেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন হলে এই ইস্যুটিতে অনেকেই সরব হন, বিশেষ করে সাদিক আব্দুল্লাহর নিপীড়নের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রচণ্ড চটেছেন।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বরিশাল সিটি করপোরেশনের হাটবাজার শাখার প্রধান নুরুল ইসলামও। তিনি অভিযোগ করেন, ‘ভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে একাধিকবার ব্যাংকটিকে নোটিশ দেওয়ার পরও কোনো সমাধান হয়নি। এ কারণে সম্প্রতি সব ভাড়া পরিশোধ করে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জায়গা খালি করে দেওয়ার নোটিস দেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী বলছেন, নোটিশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কর্ণপাত করেনি। চূড়ন্ত নোটিশ দিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভবনটি ছেড়ে দিতে বলা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকটি অন্যত্র সরিয়ে না নেওয়া হলে পরবর্তীতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, মধুমতি ব্যাংকের মালিক ফজলে নুর তাপসের রাজনৈতিক কোনো পদ-পদবি না থাকলেও তিনি আওয়ামী লীগের গত ১৭ বছরের শাসনামলে সর্বাধিক বিতর্কিতের মধ্যে অন্যতম।
বিএনপি মহাসচিব বিদেশে অবস্থানকালে তাকে আর দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না-সহ বহু বেফাঁস মন্তব্য করে আলোচনা-সমালোচনার খোড়াক হয়েছিলেন। এবং বছর দুয়েক আগে বরিশালে বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রাখতে গিয়ে খেই হারিয়ে এও বলেছিলেন, বরিশালে বিএনপির জনসভা, আমার মামাতো ভাইরে কইলেই সব সাবাড়! একটা মানুষও তো বরিশালে পা দিতে পারবেন না, মন্তব্য করেন তিনি। এ ছাড়াও আলোচিত তাপস অসংখ্য বেফাঁস মন্তব্য করেন, যা নিয়ে সে সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
মূলত এসব বেফাঁস মন্তব্যের কারণেই ফজলে নূর তাপসকে বরিশালের মানুষ বেফাঁস মন্তব্যের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তার বিতর্কিত ওই বক্তব্যের ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই ফেসবুক-ইউটিউবসহ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাকে বিকারগ্রস্ত বলেও অভিহিত করে পাবনা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এর আগেই বিতর্কিত তাপস দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দুর্নীতিবাজ তাপস ক্ষমতার আমলে গোটা দেশে ছড়ি ঘুরিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে জনরোষে পড়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। অনুরূপভাবে ৫ আগস্টের পরে তাপসের সেই আলোচিত মামাতো ভাই বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহও পালিয়ে গেছেন।
বরিশালের এই স্বশিক্ষিত জনপ্রতিনিধির নামেও বিএনপি অফিস পোড়ানোসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক এবং সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারকে কোপানোর মামলা হয়েছে। সাদিক আব্দুল্লাহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবস্থান নিয়ে থাকলেও বেফাঁস মন্তব্যের জনক তাপস কোথায় আছেন, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছেন না।
আপনার মতামত লিখুন :