চেয়ারম্যানের দায়িত্বে না থাকার সময়ে সে পদের বিপরীতে বকেয়া সম্মানীর নামে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আর্থিক সুবিধা নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই এবং বক্তব্য জানতে গিয়ে খোদ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিমের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছেন সিভয়েস২৪ অনলাইন পোর্টালের প্রতিবেদক সাংবাদিক শারমীন রীমা।
সাংবাদিকতায় ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া পদক পাওয়া এই সাংবাদিককে তিনি শুধু লাঞ্ছিতই করেননি, হুমকিও দিয়েছেন- এই সাংবাদিককে শিক্ষা বোর্ড চত্বরে দেখা গেলে আনসার-পুলিশ ডেকে বের করে দেওয়ারও। শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের এমন অপেশাদার আচরণে বিরক্ত একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, বরাবরই স্যারের একটু ‘মাথা গরম’।
শারমীন রীমাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন চট্টগ্রামে কর্মরত বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক এবং সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, সাংবাদিক শারমীন রীমা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব এবং বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রতিবেদন করার কারণে চেয়ারম্যানের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। যে কারণে তিনি একজন নারী সাংবাদিকের সাথে এমন আচরণ করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিক লাঞ্ছিত করার বিষয় নিয়ে কথা বলতে শিক্ষা বোর্ড কার্যালয়ে গেলে চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের কাছে শারমীন রীমাকে পেইড সাংবাদিক তকমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এর সপক্ষে কোনো প্রকার তথ্য-প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। দীর্ঘ আলাপচারিতায় চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শারমীন রীমাকে অপসাংবাদিক আখ্যা দিয়ে শিক্ষা বোর্ড কার্যালয়ে কর্মরত আনসার ও পুলিশ ডেকে শারমীন রীমাকে শিক্ষা বোর্ড চত্বর থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাম ও বয়স সংশোধন, পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ লেখা, যাচাই, স্বাক্ষর এবং পাঠানোর কাজে শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালায় সম্মানী দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও শিক্ষা বোর্ডের ৯৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর হিসাবের বিপরীতে ৩ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যে সময়ের কর্মঘণ্টা বিবেচনায় এই সম্মানী বণ্টন করা হয়, সে সময়ে শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে না থেকেও নিজ নামে সাড়ে ৫ লাখ টাকা অনুমোদন এবং গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান রেজাউল করিম নিজেই। যদিও বোর্ড কর্তাদের দাবি, বোর্ড কমিটির অনুমোদনে এই বকেয়া বণ্টন করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বোর্ডেও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিধি অনুযায়ী এই টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।
গত বছরের শেষেÑ অর্থাৎ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে তিনটি চেকে বোর্ডের তহবিল থেকে তিন কোটি টাকা বণ্টন করেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম। এদিকে শিক্ষা বোর্ডের নিজস্ব কোনো আর্থিক বিধি না থাকায় শিক্ষা বোর্ড অধ্যাদেশ-১৯৬১ অনুযায়ী বোর্ডের আর্থিক কর্মকাণ্ড সরকারি আর্থিক বিধিÑঅর্থাৎ জিএফআর অনুযায়ী চালানোর স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সে নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বকেয়া সম্মানীর নামে বিপুল পরিমাণে সরকারি অর্থ পানির মতো বণ্টন করেন বোর্ড চেয়ারম্যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিএফআর ভঙ্গ করে এ ধরনের অর্থ ব্যয়ে এর আগে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর আপত্তি জানিয়েছিল। তিন কোটি টাকা লোপাটের এই তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অশোভন আচরণ, অশালীন বক্তব্যসহ নানানভাবে লাঞ্ছিত হন চট্টগ্রামের এই নারী সাংবাদিক।
সাংবাদিক শারমীন রীমা চট্টগ্রাম বোর্ড চেয়ারম্যান রেজাউর করিমের গাত্রদাহ হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, অধ্যাপক রেজাউল করিম চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব থাকাকালীন ২০২৩ সালের ১২ জুন ‘হাতে হাতে টাকা নিয়ে সমালোচনার মুখে বোর্ড সচিব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেন শারমীন রীমা। নগদ টাকা গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাবলিক পরীক্ষার ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন রেজাউল করিম।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বোর্ডের নিচতলার আঙিনার প্রবেশমুখে মোজাইক করা চারটি টাইলস ভেঙে ফেলে ওএমআর শিট বহন করা মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেডের একটি গাড়ি। যদিও টাইলস ভেঙে যাওয়ার এক মাসের মাথায় বোর্ডের নিজস্ব অর্ধায়নে টাইলস মেরামত করে কর্তৃপক্ষ। নিজস্ব অর্থায়নে টাইলস মেরামত করার পরও ক্রস চেক ছাড়া নগদ অর্থ গ্রহণ করায় সে সময়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন রেজাউল করিম। তবে সাবেক সচিব রেজউল করিমের দাবি, টাইলস ভেঙে যাওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এই অর্থ নেওয়া হয়েছিল।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সাংবাদিক নাজেহালের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহ নেওয়াজ। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই এবং সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে গিয়ে বারবার সাংবাদিকদের অধিকার লুণ্ঠন করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, পেশাগত কাজে গেলে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করতে হবে। কোনোভাবেই তাদের অসম্মান করা যাবে না।
সাংবাদিক শারমীন রীমাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের হাতে সাংবাদিক লাঞ্ছনার এ ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করেন সংগঠনের নেতারা।
সিইউজের নবনির্বাচিত সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ যৌথ বিবৃতিতে আরও বলেন, এ ঘটনায় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যা পেশাগত দায়িত্ব এবং কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বড় ধরনের হুমকি। সিইউজের নেতারা অবিলম্বে সাংবাদিক লাঞ্ছনার এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
আপনার মতামত লিখুন :