জামিনে মুক্ত হয়ে চোখে মুখে অন্ধকার আর হতাশার ছাপ বিজিবি সদস্য আলতাফ হোসেনের। ১৬ বছর জেল জীবনে হারিয়েছে ২৬ জন নিকট আত্মীয় স্বজন। পায়নি মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি। জীবন বাজি রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষা করতে এগিয়ে যাওয়া সৈনিক মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণের অনুমতি পায়নি। স্হানীয়দের দাবি দ্রুত আলতাফ হোসেনসহ সকল বিজিবি সদস্যদের সরকার থেকে পুনর্বাসন করা হোক।
দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর নিজ বাড়িতে ফিরেছেন বিডিয়ার বিদ্রোহ মামলায় জামিন পাওয়া ল্যান্স নায়েক বরগুনার অলতাফ হোসেন। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি হারিয়েছেন মাসহ পরিবারের ২৬ স্বজনকে। এমনকি মায়ের জানাজায় উপস্থিত থাকতে প্যারলে মুক্তির আবেদন করলেও মেলেনি অনুমতি। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে মুক্তির পর এখন চাকরি পুনর্বহালের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন আলতাফ ও তার পরিবারের সদস্যরা।
সাবেক বিডিআর বর্তমান (বর্ডার গার্ডের) সদস্য আলতাফ হোসেনের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ১ নম্বর বদরখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাওয়ালকার নামক এলাকায়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে ১৯৯২ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি বিডিআরে যোগাদন করেন। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশনায় ২০০৯ সালের ৩ মার্চ বিডিআর ১৩ ব্যাটালিয়নের ল্যান্স নায়েক হিসেবে পিলখানায় যোগদান করেন আলতাফ হোসেন। এরপর মর্মান্তিক পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছর ২৩ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় ২ বছর বয়সী এক ছেলে এবং ৪ বছর বয়সী এক মেয়েকে রেখে কারাবন্দী হতে হয় আলতাফ হোসেনকে।
পরবর্তীতে আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরসহ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে বিভাগীয় মামলায় তার সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দায়েরকৃত হত্যা মামলায় তিনি খালাস পান। এছাড়া বিষ্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে গত ১৯ জানুয়ারি জামিন পেয়ে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৩ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৬ বছর পর বরগুনায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন আলতাফ হোসেন। তবে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে ২৬ জন স্বজনের সঙ্গে ২০২২ সালে মৃত্যু হয় তার মা আমেনা বেগমের।
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে থাকায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণসহ পরিবারের হাল ধরেন আলতাফ হোসেনের সহধর্মিণী শিরীন সুলতানা। একদিকে স্বামীর মামলা পরিচালনার খরচ, অপরদিকে দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অমানবিক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। বুঝতে শেখার আগে বাবা দূরে আছেন জানিয়ে বুকে কষ্ট চাপিয়ে বড় করতে হয়েছে ছেলে-মেয়েকে। টাকার অভাবে অনেক সময় তিনবেলা ঠিকভাবে খাবার যোগাতেও হিমসিম খেতে হয়েছে শিরীন সুলতানাকে।
সরেজমিনে আলতাফ হোসেনের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, দীর্ঘ বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরায় আনন্দের জোয়ার বইছে গ্রাম জুড়ে। দূর-দুরন্ত থেকে স্বজনরা ছুটে এসেছেন আলতাফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে। ১৬ বছর পর স্ত্রী সন্তানদের কাছে পেয়ে আনন্দের অশ্রুও ঝরছে আলতাফের। ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত স্থানসহ বিভিন্ন স্বজন ও মায়ের কবর দেখতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তবে সব কিছু কাছে পেয়েও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো বরগুনার আরও দু`জন কারাগারে থাকায় পরিপূর্ণ আনন্দ নেই আলতাফ হোসেনের। খুব দ্রুতই তাদেরও মুক্তি মিলবে এমটাই আশা করছেন তিনি।
বাবাকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরে আলতাফ হেসেনের ছেলে আকিব হোসেন রাফি বলেন, ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। আমাদেরকে কখনোই ঠিকভাবে বলেনি বাবা কারাবন্দি। বুঝতে শেখার পরে জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছে। ছোটবেলায় যখন দেখতাম স্কুলের বিভিন্ন বাচ্চাদেরকে তাদের বাবা এসে নিয়ে যায় কিন্তু আমরা বাবার সেই আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মায়ের সঙ্গে কান্নাকাটি করতাম আমাদের বাবা কেন আসেনা, কখন আসবে তা জানতে চাইতাম। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলটা খুবই কষ্টের ছিল। মা একা আমাদেরকে মানুষ করেছে। আমার বোন বরিশালে কৃষি ডিপ্লোমা এবং আমি বরগুনা সরকারি কলেজে লেখাপড়া করছি। তবে আমাদের বিপদের সময় বরগুনার মানুষ বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্বামীর অবর্তমানে পরিবারের হলা ধরা সাবেক বিডিআর সদস্য আলতাফ হোসেনের স্ত্রী শিরীন সুলতানা আসমা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমার স্বামী জেলে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী থাকতেও স্বামী ছাড়া থাকতে হয়েছে, এ কষ্ট শুধু একজন ভুক্তভোগী নারীই বুঝতে পারবে। আমার মেয়েটাকে ডাক্তারী পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি। আল্লাহর হুকুম এবং আমার বাবা, মা, ভাই ও দেবরে সহযোগিতায় যতটুকু সম্ভব হয়েছে ছেলে মেয়েদের জন্য চেষ্টা করেছি। এমনও অনেক দিন গেছে টাকার অভাবে ঘরে খাবার কিনতে পারি নাই । খাবারের জন্য মেয়ে কান্না করছে তখন বলেছি আম্মুকে চুমা দেও দেখবা তোমার ক্ষুধা কমে গেছে। একজন পরাজিত মায়ের সন্তানের সামনে এর থেকে কষ্টের জীবন আর কি হতে পারে? ছেলে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারা মায়ের বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান কথা।
তিনি আরও বলেন, যখন ছেলে মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম তখন ছেলে তার বাবাকে চিনতে পারতো না। বাবা তার মেয়েকে চিনতে পারতো না। আমরাও এই দেশের জনগণ কিন্তু সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকার কখনো কোনো বিডিআর সদস্যের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়নি। এছাড়াও যখন আমার শাশুড়ী মারা যায় তখন সরাসরি আমি জেলারের কাছে ফোন করেছিলাম। জানাজায় উপস্থিত থাকতে এবং মৃত্যু মাকে দেখার জন্য অনুমতি চাইলেও তিনি তখন বলেন সম্ভব না। অবশেষে জামিনে আমার স্বামীর মুক্তি মিলেছে। আমাদের একটাই দাবি বিনাদোষে কেনো আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে? কেনো আমাদের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে? আমরা ওই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার চাই। এছাড়াও আমরা পূনরায় চাকরি ফেরত এবং ক্ষতিপূরণসহ বেতন ভাতা পরিশোধ করার দাবি জানাই।
দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরে আলতাফ হোসেন রুপালী বাংলাদেশকে বলেন, বন্দীদশা জীবনের শুরু হলে সন্তানসহ পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমার পরিবারটি আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারব কিনা তার কোন নিশ্চয়তাই আমাদের ছিল না। সব থেকে বেশি পীড়া দেয়ার বিষয় হচ্ছে যখন ছেলে মেয়ে কারাগারে আমার সঙ্গে দেখা করতে যেত তখন তারা আমাকে চিনতো না। বাবাকে সন্তানেরা চেনে না এটা যে কত কষ্টের তা বলে বুঝানো যাবে না। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা অপূরণীয়।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পূর্বে ধরেই নিয়েছিলাম আর কখনো হয়তো কারাগার থেকে বের হতে পারব না। জেলখানায় একটি কথা প্রচলন আছে `হয়তো হাটিয়া নয়তো খাটিয়া` আমাদের ধারনা ছিল আমাদের খাটিয়াই বের হবে। ৫ আগস্টের পর আমাদের ধারণা পাল্টাতে শুরু হয়। তবে এখনো পরিপূর্ণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারছি না। বরগুনার আরও দু`জন একত্রে আমরা সঙ্গে কারাগারে বন্দি ছিল। তাদের এখনো জামিন হয়নি, যখন তারাও বের হয়ে আসবে তখন পরিপূর্ণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারব।
পিলখানার হত্যাকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিলখানা একটি বড় এলাকা, সবকিছু আমরা জানিনা। কি ঘটেছিল তা বলতে পারব না। নতুন করে তদন্ত করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস এখন সবকিছুরই সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে।
ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিডিআর সদস্যদের জন্য বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নামে একটি গ্রুপ আছে। ওই পরিষদের মাধ্যমে আমাদের চাকরির পুনর্বহল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়াসহ যে সিদ্ধান্ত আসবে আমি সেই সিদ্ধান্তে একমত। ব্যক্তিগতভাবে কোন চাওয়া নেই। তবে এটুকু বলতে পারি সর্বোচ্চ আদালত থেকে কয়েকবার আমি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। কিন্তু বারবার আপিল করে আমাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। যেহেতু আমি হত্যা মামলা থেকে নির্দোষ হিসেবে অব্যাহতি পেয়েছি এ কারণে আমার চাকরি ফিরে পাওয়া সহ ক্ষতিপূরণে কোনো বাঁধা থাকার কথা নয়।
আপনার মতামত লিখুন :