ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫
সরকারি বই চুরি

গায়েব ১৭ হাজারের বেশি বই, জব্দ ৯৬৭০

মাসুদ রানা, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম

গায়েব ১৭ হাজারের বেশি বই, জব্দ ৯৬৭০

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শেরপুরে পুলিশের হাতে আটক হওয়া মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯ হাজার সরকারি বই রৌমারী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে রৌমারী উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্তে ‘কেঁচো খুরতে সাপের’ অস্তিত্ব পেয়েছেন তারা। উদ্ধার হওয়া বইয়র চেয়ে গোডাউনে বই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে উপজেলা প্রশাসনসহ শিক্ষা বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গত ২২ জানুয়ারি রাতে শেরপুর সদর উপজেলায় ট্রাকভর্তি বই জব্দ করে পুলিশ। সেখানে ২০২৫ সালে সরকারিভাবে বিতরণের জন্য বরাদ্দকৃত মাধ্যমিক পর্যায়ের অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের ৯ হাজার বই রয়েছে। বইগুলো কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে জানায় পুলিশ। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করে রৌমারী উপজেলা প্রশাসন। একই সাথে শিক্ষা বিভাগও তদন্ত করে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের গোডাউনে বই ঘাটতির প্রমাণ মিলেছে। ঘাটতির পরিমাণ উদ্ধার হওয়া বইয়ের প্রায় দ্বিগুণ। শুধু তাই নয়, গোডাউনে কিছু বাড়তি বইও পাওয়া গেছে। তবে সেসব বইয়ের কোনও চালান ও নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি।তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, গোডাউনে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার ৫৩৩ টি। এর মধ্যে শেরপুর থানা কর্তৃক ৯ হাজার ৬৭০ টি বই উদ্ধার হয়েছে। অবশিষ্ট ৭ হাজার ৮৬৩ টি বইয়ের কোনও হদিস মেলেনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, একই গোডাউনে ৯ম ও ১০ ম শ্রেণির ভূগোল ও পরিবেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতা, পৌরনীতি ও নাগরিকতা, ইসলাম শিক্ষা এবং হিন্দুধর্ম শিক্ষা বিষয়ের মোট ৮ হাজার ৫৬১টি বই মজুদ রয়েছে। তবে তার কোনও চালান কপি পায়নি তদন্ত কমিটি। বইগুলো কীভাবে গোডাউনে এসেছে সে বিষয়ে গোডাউনের দায়িত্বে থাকা উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার ও অফিস সহায়ক কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রৌমারীতে ২০২৫ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৬৬ হাজার ৭৫০ টি বই। এর মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪১ হাজার ৭৮১ বই বিতরণ করা হয়েছে। সে হিসেবে শিক্ষা অফিসের গোডাউনে আরও ২৪ হাজার ৭৬৭ বই থাকার কথা। তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি শিক্ষা অফিসের গোডাউনে মোট বই পেয়েছে ৭ হাজার ৪৩৬টি। বরাদ্দ ও বিতরণের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৭ হাজার ৫৩৩ টি বই ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে শেরপুরে ৯ হাজার বই উদ্ধার হলেও বাকি বইয়ের কোনও হদিস মেলেনি।

বই চুরিতে জড়িত কারা?: সরকারিভাবে বিনামূল্যে বিতরণের বই উদ্ধারের ঘটনায় শেরপুর থানা পুলিশ বাদী হয়ে  ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ট্রাক চালক সজল মিয়া এবং বইয়ের সাথে থাকা মাহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে শেরপুর থানা পুলিশ। মাহিদুলের বাড়ি রৌমারী উপজেলায়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহায়ক (পিয়ন) জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে কালোবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে সরকারি বই পাচার, অর্থ আত্মসাৎসহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, বিপুল পরিমাণ বই চুরি ও পাচারের সাথে শুধু নি¤œশ্রেণির কর্মচারী জড়িত থাকতে পারে না। এর সাথে বই বিতরণে জড়িত শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীলদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের দাবি করে গত শনিবার (২৫ জানুয়ারি) মানববন্ধন করেন স্থানীয়রা।

বই ও গোডাউনের দায়িত্বে ছিলেন যারা: জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রৌমারী উপজেলা শিক্ষা অফিসের গোডাউনে রাখা বই সংরক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মোক্তার হোসেন, অফিস সহকারী আখেরুল ইসলাম এবং পিয়ন জামাল উদ্দিন। প্রাথমিক তদন্তে তাদের প্রত্যেকের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে।এদিকে বই উদ্ধারের ঘটনায় দায়িত্বে থাকা পিয়ন জামালকে গ্রেফতার করা হলেও অপর দুই দায়িত্বশীল উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার এবং অফিস সহকারী আখেরুল ইসলাম বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিসার (ডিইও) শামসুল আলম।ডিইও বলেন, ‘পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। একাডেমিক সুপারভাইজার এবং অফিস সহকারী দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এখনও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’ জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও বইয়ের গোডাউনের মজুদ ও বিতরণ যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান ডিইও।

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন, ‘ তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বই পাচারের ঘটনায় আরও কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সাথে প্রাথমিক পর্যায়ের বইয়ের হিসাবও মিলেয়ে দেখার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

আরবি/জেডআর

Link copied!