আবার ঘুরবে রেলের চাকা। খুলবে রেলের বন্ধ দুয়ার। আবার হুইসেল বাজিয়ে ছুটবে যাত্রীবাহী ট্রেন। স্টেশনে স্টেশনে শুরু হবে ব্যস্থতা। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ফিরবে প্রাণ। বন্ধ থাকা সিলেট-ছাতক রেললাইন সংস্কারের ঘোষণার পর থেকে সেই অঞ্চলের বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সংস্কার শুরুর কথা রয়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. নুরুল ইসলাম বলেন, রুটটি চালুর জন্য এরই মধ্যে টেন্ডার হয়েছে। লাইন মেরামত সম্পন্ন হলে পুনরায় ছাতকগামী ট্রেন চলাচল শুরু করবে।
সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগের মধ্যে শিল্পাঞ্চল হিসেবে একসময় সুপরিচিতি ছিল ছাতক। ফলে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সিলেট-ছাতক রেলপথটি। এই রুটের ট্রেনে শুধু যাত্রী চলাচল করত না, স্থানীয় কৃষি ও শিল্পে রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। প্রথম দিকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে পণ্য সরবরাহের জন্য রেলপথটি চালু করা হয়। ছাতক থেকে সিলেট হয়ে বালু, পাথর, চুনাপাথর, সিমেন্ট, নিউজপ্রিন্ট কাগজসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ও কৃষিপণ্যের চালান যেত এই পথেই। দেশের একমাত্র কংক্রিট স্লিপার কারখানাটিও তখন ছিল ছাতকে। সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজারসহ আশপাশের উপজেলাগুলোতে উৎপাদিত শাকসবজি, কমলালেবু, লিচু ও তেজপাতাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য ট্রেনে করে এই পথে ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসতেন সিলেটে।
রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৫৪ সালে সিলেট থেকে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে জেলার রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর আগে এটি আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। শুরুর সময় পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে চালু করা হয় যাত্রীবাহী রেলসেবাও।
১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক স্টেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে নেয়। এরপর বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেন ও বগির সংখ্যা। ছাতক থেকে ট্রেনে প্রায় ৪৫ মিনিটে পৌঁছানো যায় সিলেটে। এই রুটের ট্রেন খাজাঞ্চিগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ এই তিন স্টেশনে যাত্রাবিরতি করত।
একসময় সড়ক যোগাযোগ উন্নত ও দ্রুততর হয়ে যাওয়ায় এই রুটে পণ্য পরিবহনের চাহিদা কমে আসে। পরবর্তীতে নিউজপ্রিন্ট কাগজ ও সিমেন্ট খারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মুখ থুবড়ে পড়ে পণ্য পরিবহন। সেই থেকে একে একে কয়েকটি স্টেশনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে চালু ছিল যাত্রীবাহী মেইল-সেবা। রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চে সিলেট-ছাতক রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সারা দেশে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও ছাতক রুটের ট্রেনের হুইসেল বাজেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যায় ৩৪ কিলোমিটার রেললাইনের ১২ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই থেকে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় যাত্রী পরিবহনসেবা। গত চার বছর ধরে এই লাইন বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি ভাড়ায় পণ্য গাড়িতে করে সিলেটে নিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে পণ্যের দামেও এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। পাশাপাশি রুট বন্ধ থাকায় বেহাত হতে শুরু করেছে রেলওয়ের নিজস্ব সম্পত্তিও।
তবে আশার কথা, ক্ষতিগ্রস্ত লাইন সংস্কার করে পুনরায় রুটে রেল চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে সিলেট-ছাতক রেলের হুইসেল ফের বাজতে যাচ্ছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেললাইনটি মেরামতের জন্য একনেকে প্রস্তাব পাশ হলেও কাজ শুরু হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সিলেট-ছাতক রেললাইন সংস্কার করে ফের ট্রেন চলাচল শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে গত ৩ জানুয়ারি রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পরির্দশন করেন।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. নুরুল ইসলাম জানান, সিলেট-ছাতক রেললাইনটি সর্বশেষ ক্ষতিগস্ত হয় ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায়। রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ওই বছরের ৬ জুন থেকে ওই লাইন ‘ওয়াস্ট রুট’ হয়ে যায়। ফলে রেল চলাচল স্বাভাবিক করা যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :