খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার ব্যাপকভাবে জেঁকে বসেছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেককিছুর পরিবর্তন হলেও নিয়োগ বাণিজ্য রয়ে গেছে একই রকম।
সেইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতি অথবা গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেওয়া কুয়েটের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
বর্তমান উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুদ কুয়েটে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বেড়েছে এসব কর্মকাণ্ড।
নিয়মবহির্ভূত শিক্ষক নিয়োগ চাকরিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় কুয়েট কর্তারা। আর্থিক লেনদেনে সক্রিয় টেন্ডার সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেট ছাড়া কাজ পায় না কোনো ঠিকাদার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুয়েটে গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর রাজস্ব খাতের বেশকিছু পদে নিয়োগ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সন্ধ্যার পর বসেছে এ নিয়োগ বোর্ড। যা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে নানা গুঞ্জন। এ ছাড়া চাকরিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় কুয়েট কর্তারা।
ইমদাদুল হক ওরফে ইমদাদ মোড়ল খানজাহান আলী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রভাব খাটিয়ে ডেটা এন্ট্রি প্রসেসর হয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পালন করছেন সেকশন অফিসারের দায়িত্ব।
স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা হিসেবে কুয়েটে সবকিছুর ওপর নিয়েছেন নিজের নিয়ন্ত্রণ। এমন কর্মকাণ্ডের ফলে কুয়েটের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি বলেন, কয়েকদিন আগে কুয়েট মডেল স্কুল (খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল) প্রাথমিক শাখায় একজন শিক্ষিক নিয়োগ হয়েছে।
যার কোনো সার্কুলার হয়নি। সার্কুলার ছাড়া এভাবে নিয়োগ দেওয়াটা সবার চোখে পড়েছে। ওই পদের জন্য অনেকেই যোগ্য ছিল।
কিন্তু সার্কুলার না থাকায় কেউ আবেদনই করতে পারেননি। এই স্কুলে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি ৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতির স্ত্রী।
কুয়েট মডেল স্কুলে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে একাধিক শিক্ষক জানান, তারা এ রকম নিয়োগ প্রক্রিয়া তাদের চাকরিজীবনে দেখেন নাই।
কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন।
মাহমুদা আক্তার মুক্তা নামে এ নতুন শিক্ষক জানুয়ারি মাস থেকে ২৪ দিন নিয়মিত ক্লাস নেন।
এ ব্যাপারে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. বেলাল হোসেনকে স্কুলে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে কয়েকদিন কল ও মেসেজ দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে এ বিষয়ে শিক্ষক মাহমুদা আক্তার মুক্তার স্বামী ৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি রুমি এর সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ বছর আমরা নির্যাতিত অবহেলিত।
এ চাকরিটা আমার স্ত্রীর তথা আমার পরিবারের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল।
আমি কুয়েটের ভিসি স্যারকে এক দিন সকালে অনুরোধ করি আমার স্ত্রীকে কুয়েটে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।
তখন তিনি বলেন, কুয়েটে তো এখন কোনো সুযোগ নাই। তবে কুয়েট মডেল স্কুলে একটা পদ খালি আছে।
এই খালি জায়গায় তোমার স্ত্রীকে পাঠায় দেও। ভিসি স্যারের পিএস আব্দুর রহমান আমাদের বন্ধু। তিনি একপর্যায়ে বলেন, আমার স্ত্রীকে স্কুলে পাঠানোর জন্য ক্লাস নিতে। এভাবেই চলছিল। আমার স্ত্রী নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছিল।
এ বিষয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আব্দুর রহমানের ব্যবহৃত ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, কুয়েটে সম্প্রতি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স আর কে এন্টারপ্রাইজের হয়ে কাজ বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি দ্বীন মোহাম্মাদের স্ত্রী পাপিয়া খানমের কথোপকথন।
পাপিয়া খানম বলেন, কুয়েটের সব কাজ এভাবেই বণ্টন হয়। তারা সিন্ডিকেটে কাজ নিলেও বুকভ্যালু থেকে বেশি রেটে কাজ নিয়েছে।
তাদের এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান মীর কায়ছেদ আলীর (মেসার্স আর কে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী) নামে তার স্বামী কাজটা নিয়েছে।
বেশ টাকা-পয়সা খরচ করে তারা কাজটা পেয়েছে। তিনি বলেন, আরেকটা টেন্ডার প্রসেসিংয়ে আছে।
সেটাও সিন্ডিকেট হয়েছে। পাপিয়া খানম আরও বলেন, সামনে দুটো টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি আসতেছে। আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।
এই কাজটা এবার নাজিফা ট্রেড লিংক করবে। যেটা তার নিজের ফার্ম।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, স্বজনপ্রীতির কারণে অথবা অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে এমন কাজ হয়ে থাকলে তা হবে রাষ্ট্র তথা জনগণের জন্য শঙ্কার।
নতুন বাংলাদেশে কুয়েটের মতো স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। পরিবর্তিত সময়ে দীর্ঘ মেয়াদে এভাবে চলতে থাকলে কুয়েটের সুনাম ক্ষুণ্ন্ন হবে।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাসুদ বলেন, স্কুলের নিয়োগ সম্পর্কে আমার জানা ছিল না।
তবে আমি শোনামাত্রই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে সেই শিক্ষকের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি।
আমার পিএস আব্দুর রহমানকেও সরিয়ে তার নিজ দপ্তরে দিয়েছি।
নিয়োগ বোর্ডের ব্যাপারে তিনি বলেন, শুক্রবার আমি একটা পিকনিকে ছিলাম। ফিরতে দেরি হয়েছে। যার কারণে সন্ধ্যার পর নিয়োগ বোর্ড বসেছে।
টেন্ডার সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাকে নির্দিষ্ট করে তথ্য দিন কে কোথায় কী অনিয়ম করছে। আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমার কাছে কোনো অনিয়মের তথ্য আসলে আমি ব্যবস্থা না নিলে তখন বলবেন।
এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ পেলে আপনারা আমাকে ধরিয়ে দেবেন।
তিনি বলেন, কুয়েটের প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে।
এখানে কাউকে ব্যক্তিস্বার্থ অথবা আর্থিক সুবিধা প্রদান করার জন্য কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :