ময়মনসিংহের সীমনান্তবর্তী দুই উপজেলা হালুয়াঘাট-ধোবাউড়ার বন্যা পরিস্থিতি কোন কোন স্থানে উন্নতি আবার কোন কোন স্থানে অবনতি হয়েছে। অন্য দিকে জেলার ফুলপুর উপজেলার নতুন অনেক স্থানে বন্যার পানি হানা দিয়েছে। এসব উপজেলায় পানি বন্দি হয়েছে ৩৩ হাজার পরিবার। সেনা বাহিনী ও বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব এলাকার মানুষের খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে রয়েছেন। এ দিকে ময়মনসিংহের ফুলপুরে বন্যার পানিতে আটকে পড়া শাশুড়িকে উদ্ধার করতে
গিয়ে জামাতা উজ্জ্বল মিয়া (৪৫) নিহত হয়েছেন।
ফুলপুর থানার ওসি আবদুল হাদী বলেন, সকাল ১০টার দিকে নিখোঁজ হওয়ার পর বিকেলে উজ্জ্বল মিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ দিকে ময়মনসিংহের দুই উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় ১৯ ইউনিয়নের মানুয় এখনো পানির সাথে লড়াই করে চলে বেচেঁ আছে। তলিয়ে গেছে কৃষি জমি। অপর দিকে সীমান্তবর্তী দুউ উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনো স্বাভাবিক হয়নি। হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে নারী শিশুসহ সাত শতাধিক মানুষ উঠেছে। তাদের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরে রাতেই বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে ভূবনকুড়া ইউনিয়নের মহিষলেটি, ধোপাজুড়া, কড়ইতলী, জুগলী ইউনিয়নের গামারীতলা, জিগাতলা, নয়াপাড়া, ছাতুগাও, কৈচাপুর ইউনিয়নের নলুয়া, জয়রামকুড়া এলাকাসহ গাজীরভিটা বোরাঘাট নদীর পানি বেড়ে সূর্যপুর, সামিয়ানাপাড়া হাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামসহ ১৯ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়।
স্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, ধোবাউড়া বন্যা দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তবে কিছু এলাকায় খাবারের ব্যবস্থা করছেন প্রশাসন। এছাড়াও নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। উজানের পানি নেমে পাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। চারদিনের টানা দুর্ভোগে দিশেহারা মানুষ। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ধোবাউড়া সদর উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের কুলসুম আক্তার বলেন, চারদিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছি। বাড়ির উঠান ও চারপাশে হাঁটুপানির কারণে রান্নাও
করা যাচ্ছে না। হাঁস-মুরগিগুলো মরে গেছে। কেউ একটু সহযোগিতাও করেনি। এদিকে হালুয়াঘাটের প্রায় সব ইউনিয়ন পাবিত হয়ে কয়েক হাজার হেক্টর জমির
ধান, সবজি খেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন মানুষজন।
আমতৈল গ্রামের সুরুজ আলী বলেন, টানা বৃষ্টিতে আমাদের বাড়িঘরে পানি প্রবশ করে। আর বৃষ্টি না হলেও পানি কমার কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। কদিন ধরে বাল
বাচ্চা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।
এদিকে, ময়মনসিংহ জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ১৫ হাজার ৪৩৮ হেক্টর ধানের জমি প্লাবিত হয়েছে। এরমধ্যে পুরোপুরি ডুবে গেছে ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমি, আংশিক ডুবেছে ৬ হাজার ৩৬০ হেক্টর এবং সবজি আংশিক প্লাবিত হয়েছে ১৫৮ হেক্টর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় এখনো ৩৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি। বন্যা দুর্গত এলাকায় এসব মানুষ উদ্ধারের পাশাপাশি চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম।
এ দিকে জেলায় নতুন করে ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর, ছনধরা ও সদর ইউনিয়ন পাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানি ভাটির দিকে নেমে আসায় বর্তমানে ফুলপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ৫ হাজার ১০০ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বরও, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের ২৫ গ্রাম পাবিত হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে পাবিত হয়েছে ১০ গ্রাম। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার।
সিংহেশ্বর গ্রামের রুহুল কাজী বলেন, আমাদের এলাকায় পানি প্রবেশ করায় দুর্ভোগ বাড়ে। ধান তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ দেখছি না।
অপরদিকে বন্যার কারণে মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ৭ হাজার ৮০ মৎস্যচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ২১৭ লাখ, ভেসে গেছে ৫ হাজার ৬২৪ লাখ টাকার মাছ ও ১৪৯ লাখ টাকার রেনো পোনা।
জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, তিনটি উপজেলার মধ্যে ধোবাউড়া উপজেলায় ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। হালুয়াঘাটে তলিয়ে গেছে ৭
হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ধান এবং ৭৫ হেক্টর সবজি ফসল। একই অবস্থা ফুলপুরেও। এই উপজেলায় ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর ধান এবং ৬২ হেক্টর সবজি ফসল পানিতে তলিয়ে
গেছে।
বন্যাকবলিত ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলা পরিদর্শন করেছে সেনাবাহিনী। এসময় দুর্গম এলাকার পানিবন্দি পরিবারগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করেন তারা। সোমবার উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের রাউতি ও বতিহালা গ্রামে এই ত্রাণ বিতরণ করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল লেনিনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করেন। এরআগে হালুয়াঘাট উপজেলার ধুরাইল ও কৈচাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পানিবন্দি নারী ও শিশুদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ধোবাউড়া উপজেলার দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। আগামীকালও দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলবে বলে জানা গেছে। এ দিকে হালুয়াঘাটে বন্যার্তদের মাঝে সোমবার দিনব্যাপী ত্রাণ বিতরণ করেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। বন্যা কবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের মধ্যে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, তার এলাকার মহাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারা এলাকায় পানি বেশি। তবে সকালে পাহাড়ি ঢলে সীমান্তে সড়কের ওপরে তিন ফুট পানি ছিল। এলাকার পুকুরের মাছ সব চলে গেছে। রবিবার বৃষ্টি না হওয়ায় আশা করা যায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, উপজেলার মোট সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে গামারীতলা, ঘোঁষগাঁও এবং দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নে কমেছে বন্যার পানি। তবে সদর, গোয়াতলা, পোড়াকানদলিয়া ও বাগবেড়সহ চারটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি থাকায় প্রায় সাড়ে ৯ হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দি।
হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ জানান, বন্যাদুর্গত উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে এরই মধ্যে ভূবনকূড়া, জুবলী, কৈচাপুর, সদর, গাজীরভিটা ও পৌর এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে ধারা, ধূরাইল, নড়াইল, সাখুয়াই, আমতৈল ও বিলডোরাসহ অপর ছয়টি ইউনিয়নে। এতে ওইসব এলাকায় বর্তমানে ১৮ হাজার পরিবার পানিবন্দি।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান, বন্যা দুর্গত এলাকায় পানিবন্দিদের উদ্ধারের পাশাপাশি চলছে ত্রাণ বিতরণ। এসব এলাকায় এরই মধ্যে ৬৩ টন চাল, ৭ লাখ নগদ টাকা এবং দুই হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :