ঢাকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মান্নানের আশীর্বাদে হাসনাতের উত্থান!

সিলেট ব্যুরো
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০১:২৮ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কারো কারো উত্থানের গল্পে তাজ্জব বনে যেতে হয়। তেমনি এক উত্থানের গল্পে তাজ্জব বনে গেছে পুরো সিলেট।

তিনি হাসনাত হোসাইন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের (রাজনৈতিক) পিএস।

মান্নান যখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, তখন থেকেই তিনি তার ছায়াসঙ্গী। তার ‘ক্লিন ইমেজের’ কালো দাগ এই হাসনাত। লোকমুখে প্রচলিত আছে, মান্নান সরাসরি কারো কাছ থেকে টাকা নিতেন না, উন্নয়নকাজের কমিশন নিতেন না।

তবে হাসনাত গ্রামাঞ্চলের মহল্লার ‘মুঠির চাল’ তোলার মতো অর্থ তুলতেন। এই টাকা শুধু তার পকেটেই যেত না। যেত অন্য আরো অনেক জায়গায়। অনেকের অ্যাকাউন্টে।

সেখানে সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নানের নামও জড়িয়ে আছে। তার আশীর্বাদেই জিরো থেকে রীতিমতো হিরো হয়ে উঠেছেন হাসনাত হোসাইন। সেই হাসনাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। গেল ১৬ বছর ধরে লিখেছেন দুর্নীতির ইতিহাস।

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন মান্নানের নির্বাচনী দুটি উপজেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। অবৈধভাবে টাকার পাহাড় গড়লেও বরাবরই থেকে গেছেন অধরা। এখনো তিনি নিরাপদ। চরিত্রে বহন করে চলেছেন তার গুরুর মত ‘ক্লিন ইমেজ’! ফলে তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অথচ তিনিই ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মান্নান যুগের অধিপতি। এম এ মান্নানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আরোহণ করেন বিতর্কের ওপরের স্তরে। তার আমলজুড়ে আধিপত্য বিস্তারসহ উন্নয়নের নামে লুটপাটের বরপুত্র ছিলেন তিনি।

যে দুজন এম এ মান্নানের রাজত্ব দেখাশোনা করতেন, তাদের একজন এই হাসনাত। সেই রাজত্বের আরেক নিয়ন্ত্রক, এম এ মান্নানের এপিএস (রাজনৈতিক) জুয়েল হোসেনকে ইতিমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে নিরাপদে আছেন হাসনাত। গ্রেপ্তার এড়াতে ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি।

হাসনাত সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সাবেক এমপি এম এ মান্নানের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তখন তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজনীতির পট পরিবর্তন করে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ) আসনে সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে লুটপাটের চাবি ছিল তারই হাতে। এম এ মান্নানের দয়ায় সেই হাসনাত রাজনীতির খোলস পাল্টে এখন শান্তিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

অভিযোগ রয়েছে, সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটসহ উপজেলা পরিষদের অবকাঠামো নির্মাণ ও ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দুর্নীতিবাজ হাসনাত হোসাইন।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজসহ বেশ কিছু স্থাপনার মাটি ভরাটের নামে রমরমা বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয়রা জানান, হাসনাত যত টাকার মালিক, সুনামগঞ্জের অন্য ৪ এমপির পিএস তো দূরের কথা, এমপিদেরও এত টাকা হয়তো নেই। এলাকার সব কাজের জন্য তাকে দিতে হতো নির্দিষ্ট হারে কমিশন।

এম এ মান্নানের সবচেয়ে কাছের লোক হিসেবে পরিচিত হাসনাত তার আমলে দাপটের সাথে মন্ত্রীর পরিচয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব করেন। মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে পুরো জেলার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও কমিশন এসে যোগ হতো তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। বিশেষ করে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প যোগসূত্র থাকত এম এ মান্নানের।

দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দিলেও তাকে এ পদ থেকে অপসারণ করা যায়নি। এম এ মান্নান এই আসন থেকে ৪ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। দলের হাইব্রিড নেতা হওয়ার পরও শুধু একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় মান্নানের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন তিনি।

হয়ে ওঠেন তার ব্যক্তিগত সহকারী। এরই সুবাদে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। সেই সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে ছিলেন মান্নানপূত্র সাদাত মান্নান।

আর দুই সিপাহসালার ছিলেন হাসনাত এবং জুয়েল! তারাই সামনে থেকে সব দেখভাল করতেন। আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন সাদাত মান্নান। সব কিছু দেখাশোনার মূল ভারটা ছিল হাসনাতের ঘাড়ে।

সুযোগ পেয়ে সিন্ডিকেট বাণিজ্যের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার, জলমহাল নিয়ন্ত্রণ, পানি উন্নয়ন বোর্ডে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, টিআর, কাবিখা, খাদ্য গুদামে ধান-চাল, ইউপি নির্বাচনসহ নানা দিকে অবৈধ আর্থিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে জড়িয়ে পড়েন।

তারা ইউপি ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়া, থানা পুলিশের পোস্টিং বাণিজ্যেও নাম লেখান। এ ছাড়া ভূমি বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট।

হাসনাত এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। তার এসবের আশীর্বাদ হয়ে মাথার ওপরে ছিলেন এম এ মান্নান।

তিনিই তাকে ছায়া দিয়েছেন, মায়া দিয়েছেন। তার আশকারায় অপরাধকাণ্ডে জড়িয়ে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার রয়েছে সিলেট শহরে ও সুনামগঞ্জে বাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি।

হাসনাত আলোচনায় আসেন আপন ছোট ভাই নুর হোসেন শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে।

অভিযোগ ওঠে, নিজের প্রভাবের কারিশমায় নূর একদম পিছিয়ে থেকেও জয়লাভ করেন। বিষয়টি তখন পুরো সুনামগঞ্জে আলোচনার খোরাক জোগায়। নূর জয়লাভের পরে দুই ভাই মিলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির গল্প রচনা করতে থাকেন।

দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে নুর হোসেন উপজেলার বিভিন্ন দপ্তর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন। তার খুঁটিতে জোর দিচ্ছিলেন হাসনাতই।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত হাসনাত হোসাইনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নাম্বার খোলা থাকলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

তবে তার ভাই নুর হোসেন বলেন, আমি বা আমার ভাই কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতিতে জড়িত নই। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।