শেরপুরে পুলিশের হাতে আটক হওয়া মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯ হাজার সরকারি বই কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার হোসেনের ‘নির্দেশে’ গোডাউন খুলে ট্রাকে বই তোলা হয়েছিল বলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন গ্রেপ্তার অফিস সহায়ক (পিয়ন) জামাল উদ্দিন।
শেরপুর থানার ওসি জুবায়দুল আলম এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত ২২ জানুয়ারি রাতে শেরপুর সদর উপজেলায় ট্রাকভর্তি বই জব্দ করে পুলিশ।
সেখানে ২০২৫ সালে সরকারিভাবে বিতরণের জন্য বরাদ্দকৃত মাধ্যমিক পর্যায়ের অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের ৯ হাজার ৬৭০ বই রয়েছে। বইগুলো কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে জানায় পুলিশ। বই উদ্ধারের ঘটনায় শেরপুর থানা পুলিশ বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ট্রাকচালক সজল মিয়া এবং বইয়ের সঙ্গে থাকা মাইদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহায়ক (পিয়ন) জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করে রৌমারী উপজেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা বিভাগ।
তদন্তে রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের গোডাউন থেকে বই পাচারের সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন পিয়ন জামাল উদ্দিন
গত ২৩ জানুয়ারি রৌমারী থেকে পিয়ন জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ২৪ জানুয়ারি শেরপুর আদালতে হাজির করা হলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বই পাচারে জড়িত থাকার কথা জানিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জামাল। শেরপুর থানা পুলিশ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, পিয়ন জামাল উদ্দিন তার জবানবন্দিতে বই পাচারে জড়িত কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন।
এর মধ্যে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কামরুল ইসলাম, একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার হোসেন এবং মাইদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নাম রয়েছে। এ ছাড়াও পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ঢাকার মাতুয়াইলে অবস্থিত রেজা প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার পদে কর্মরত মনির নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। মনির এবং মাইদুলের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারীতে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পিয়ন জামাল উদ্দিন বলেছেন, ‘গত ২০ জানুয়ারি রাতে একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার হোসেন তাকে (জামালকে) বিতরণের পর থাকা অবশিষ্ট বইগুলো গাড়িতে তুলে দিতে বলেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার কামরুল ইসলামের সঙ্গে তার কথা হয়েছে বলে জামালকে জানান মুকতার হোসেন। মুকতারের কথামতো গোডাউনের দরজার তালা খুুলে দেন জামাল। মাইদুল ইসলাম লেবার দিয়ে বইগুলো গাড়িতে তুলে নিয়ে যান।’
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের গোডাউনে রাখা বই সংরক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার হোসেন, অফিস সহকারী আখিরুল ইসলাম এবং পিয়ন জামাল উদ্দিন। এদের মধ্যে মুকতার হোসেন ৬ বছর ধরে, আখিরুল এক বছর ধরে এবং পিয়ন জামাল উদ্দিন প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রৌমারীতে কর্মরত। প্রাথমিক তদন্তে তাদের প্রত্যেকের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। তাদের হেফাজত থেকে এবারই প্রথম নাকি আগেও সরকারি বরাদ্দের বই চুরি হয়েছে তা তদন্ত করছে পুলিশ।
বইয়ের দায়িত্বে থাকা তিন কর্মচারীর মধ্যে শুধু পিয়ন জামাল উদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছেন। একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার এবং অফিস সহকারী আখিরুল ইসলাম বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাদের এখনো সাময়িক বরখাস্তও করেনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। পুলিশও তাদের গ্রেপ্তারে ধীরে চলার নীতি নিয়েছে।
একাডেমিক সুপারভাইজর মুকতার হোসেন বলেন, ‘পুলিশ এবং আমার ডিপার্টমেন্ট বিষয়টি তদন্ত করছে। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার নাম বললেই তো হবে না। সে (পিয়ন জামাল) কোনো লিখিত দেখাতে পারবে?’ ঘটনার দিন ২০ জানুয়ারি কর্মস্থল রৌমারীতে থাকার প্রশ্নে মুকতার বলেন, ‘হ্যাঁ, সেদিন ছিলাম।’
রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘রৌমারীতে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। বই চুরি ঘটনার আগে শুধু এক দিন গত ১২ জানুয়ারি রৌমারীতে গিয়েছিলাম। ২২ জানুয়ারি বিষয়টি জানতে পারি। বইয়ের দায়িত্বে তিনজন ছিল। আমি কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নই। তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসবে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শেরপুর থানার এসআই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জামাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বই পাচারে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সার্বিক বিষয় জানিয়ে কুড়িগ্রাম শিক্ষা বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি তদন্তাধীন। প্রিন্টিং প্রেসের কর্মচারী মনির পলাতক। তাকে গ্রেপ্তার করলে আরও কেউ জড়িত রয়েছে কি না এবং এর আগে বই পাচার হয়েছে কি না তা জানা যাবে।’ যোগ করেন এসআই।
ডিইও শামসুল আলম বলেন, ‘পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না বলে জানতে পেরেছি।
একাডেমিক সুপারভাইজর এবং অফিস সহকারী দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করেছেন। তারা ক্ষমা চেয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এখনো কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। ’