স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫, ০২:২৭ এএম

স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিদিন এই বন্দরে আসছে বিদেশি ফ্লাইট। সেই ফ্লাইটগুলোতেই আসে স্বর্ণ।

বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই, বাহরাইন, সৌদি আরব থেকে আসে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চালান। এর মধ্যে দুবাই চালানের বড় উৎস

সিলেট হয়ে স্বর্ণ এসে দেশে ঢুকলেও এসব চলে যায় রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে। যার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকার রাঘববোয়ালরা। তাদের তালিকায় আছেন দেশের স্বর্ণের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে মাঝেমধ্যে চালান আটক হলেও রাঘববোয়ালরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। 
ওসমানী বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে এই বিমানবন্দর থেকেই জব্দ করা হয়েছে অন্তত ১৭০ কেজি স্বর্ণ। বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক করা হয় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ। ২ যাত্রীর লাগেজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২১ কোটি টাকা।

এই স্বর্ণের চালানসহ দুজনকে আটক করেছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও শুল্ক গোয়েন্দা। এর আগে আরেক বড় চালান আটক করা হয় গত ২৮ আগস্ট বুধবার। ওইদিন সকালে ওসমানী এয়ারপোর্টে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৬ কেজি ওজনের স্বর্ণের চালান জব্দ করা হয়। 

অভিযোগ রয়েছে, ওসমানী বিমানবন্দরে একের পর এক স্বর্ণের চালান আটক হলেও এর মূল মালিক বা নেপথ্যের কারিগরদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

 সবশেষ দুটি বড় চালানের হোতা দেশের দুই শীর্ষ স্বর্ণ চোরাকারবারি বলে একাধিক সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে। যারা ডায়মন্ড ও স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সিভিল অ্যাভিয়েশনের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় সিলেট রুট ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা।

সবসময় চালান আটকের পর পুলিশ স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় মামলা দায়ের করার কথা জানিয়ে দাবি করে, চোরাচালানের মূল হোতা শনাক্ত করতে সবধরনের তদন্ত কার্যক্রম চালানো হবে। কিন্তু পরে সেই তদন্ত কার্যক্রম আর এগোয় না।

সিলেট বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সচেতন এবং সতর্ক আছি বলেই আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণের চালান ঢুকতে পারছে না। সমন্বিতভাবে আমরা চেষ্টা করছি। অপরাধীদের বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

সূত্র জানায়, ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে একটি শক্তিশালী চোরাচালানি চক্র সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। এর বাইরে সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে স্বর্ণের ছোট ছোট চালান আসে। তবে, আটক হওয়া চোরাচালানের মধ্যে বেশিরভাগ চালানই দুবাই থেকে নিয়ে আসা হয়।

যাত্রীবেশে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিয়ে আসা হয়

আর এক্ষেত্রে স্বর্ণ চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওসমানী বিমানবন্দরে গতকাল থেকে গত ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১৭৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় দুবাইয়ের শারজাহ এয়ারপোর্ট থেকে আসে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট বিজি-২৫২। 

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই ফ্লাইটে অবৈধ স্বর্ণের চালান আসছে গোপন সূত্রে এমন তথ্য পায় জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)।

এই তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দরে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। এ সময় ওই ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের মধ্যে সৈয়দ আহমদ ও আফতাব উদ্দিনকে সন্দেহ হলে তাদের লাগেজ তল্লাশি করেন বিমানবন্দর এনএসআই ও শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট সেই একই রুট সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের (বিজি-২৫২) যাত্রী ছিলেন হোসাইন আহমদ। তার কাছে থাকা লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে একটি জুস মেশিনে ১০৫টি স্বর্ণের বারসহ আরও কিছু স্বর্ণ পাওয়া যায়। জব্দকৃত সোনার ওজন ১৫ কেজি ৯১৫ গ্রাম।

যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এর আগে গত ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিক্যুইড গোল্ড জব্দ করে কাস্টমস। ২০২২ সালের জুন মাসে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুটি চোরাচালান ধরা পড়ে।

২ জুন দুবাই ফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২৭ মে আলী আহমদ নামের আরেক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সমপরিমাণ স্বর্ণ।

২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম স্বর্ণসহ দুবাই থেকে আসা চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস।

এই চার যাত্রী ব্ল্যান্ডার মেশিন ও আয়রন মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন। ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

পরে নরেন্দ্র নাথকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ (২৮) নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল।

২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা।

একই বছরের ৩ জানুয়ারি ফ্লাই দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কারিমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। স্বর্ণের এই চালান আটক করা হলেও এর সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস।

উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশি চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সিটের নিচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়।

তবে, এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৪ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস।

এ ছাড়াও ১০০ ও ২০০ গ্রাম স্বর্ণ আটক, শুল্কায়ন, ন্যায় নির্ণয়নের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!