বিগত সরকারের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নামে-বেনামে গজিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের ২৫টি গ্রুপ। গোটা রূপগঞ্জেই দাবড়ে বেড়াচ্ছে এরা। এসব গ্রুপের রয়েছে চার শতাধিক সদস্য। যাদের কাজই হলো এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে নিজেদের বীরত্ব জাহির করা। তাদের পেছনে কাজ করে এলাকার তথাকথিত রাজনৈতিক বড় ভাই। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কথিত বড় ভাইয়েরা গা-ঢাকা দিলে কিছুটা কমে আসে এসব অপকর্ম। তবে তাদের দৌরাত্ম্য রূপগঞ্জে আবারও আগের মতোই বেড়ে গেছে।
কিশোর গ্যাংয়ের হাতে জোড়া খুনের মধ্যে দিয়ে আবারও সামনে আসে এসব অপরাধী। যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-খাতা আর সেই বয়সেই হাতে দেশি-বিদেশি অস্ত্র থাকায় দুশ্চিন্তায় ভুগছেন পরিবার-পরিজন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশিষ্টজনেরা। আর এসব অপরাধী দমনে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীÑ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
[33381]
রাজধানীর উপকণ্ঠ রূপগঞ্জ। নানা শিল্প-কারখানা ও পূর্বাচল উপশহর ঘিরে এখানে রয়েছে গোটা দেশের মানুষের যাতায়াত। কর্মব্যস্ত এ শিল্পনগরীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিগত দিনে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এখানে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৫টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এদের কারণে গোটা রূপগঞ্জ উপজেলায় বাড়ছে হানাহানি-সংঘাত। মাদক বিক্রি-সেবন, খুন, ধর্ষণসহ হেন অপকর্ম নেই, যা এরা করছে না। দিনদিন তারা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। দিবানিশি চলে তাদের নানা অপকর্ম।
রূপগঞ্জে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যে কিং মাস্টার, ডি কোম্পানি, টাইগার গ্যাং, টেনশন গ্যাং, ডেঞ্জার গ্রুপ, শাওন গ্রুপ, সুইচ গ্রুপ, স্যাভেজ গ্রুপ, কুড়াল গ্রুপ, পিনিক গ্যাং, হাতুড়ি গ্যাং, সজীব গ্যাং, আমির গ্যাং, ইভান গ্যাং, পাটানী গ্যাং, আলেক্স গ্রুপ, সেভেন স্টার গ্রুপ, ইয়াং স্টার, ব্লেড গ্যাং, কসাই গ্যাং, লাদেন গ্যাং ও বাবা গ্যাং দাবড়ে বেড়াচ্ছে। রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়ায় ৪টি, তারাব পৌরসভায় ৫টি, কাঞ্চন পৌরসভায় ৩টি, ভুলতা ইউনিয়নে ২টি, গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে ২টি, রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ও ৩০০ ফুট সড়ককেন্দ্রিক ২টি, ভোলাব ইউনিয়নে ২টি, দাউদপুর ইউনিয়নে ২টি, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন ও চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৫টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারীদের জীবনে নেমে আসে অমাবস্যা।
[33362]
গুম, খুন, পরিবারের লোকজনের ওপর হামলা, বাড়িঘরে লুটপাট, ভাঙচুর, জমি দখলসহ নানাভাবে বিষিয়ে তোলে প্রতিবাদকারীদের জীবন। ফলে ভয়ে এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায় না ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়রা। অপরাধী কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেও রাজনৈতিক গডফাদারদের কারণে সঠিক বিচার পান না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তারাব দক্ষিণপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো ছুরিকাঘাতে জখমের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রাশেদুল ইসলাম (১৬) ও জুনায়েদ আহাম্মেদ হৃদয় (১৭) নামে দুই কিশোর। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে উপযুক্ত বিচার দাবি করেন ভুক্তভোগী পরিবারসহ স্থানীয়রা।
২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল ভুলতা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে প্রেম সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোরের মধ্যে সংঘর্ষে সজীব নামে এক কিশোর নিহত হয়। একই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর ঘুম ভেঙে দেওয়ায় দাউদপুরের দুয়ারা এলাকায় কিশোরের ছোট ভাই জামিল হত্যা করে তার বড় ভাই আশরাফুলকে। ওই বছরই ১৩ নভেম্বর ভোলাব ইউনিয়নের পাইস্কা এলাকায় তিন কিশোর মিলে হত্যা করে তাদের বন্ধু কিশোর মাওলাকে। ২০২২ সালের ১৭ জুন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চনপাড়া পুনর্বাসন এলাকায় কিশোর দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে সজল নামে এক কিশোর নিহত হয়। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ায় গোলাকান্দাইল বেড়িবাঁধ এলাকায় দুই কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে সানি নামে একজন নিহত হয়। ২০২০ সালে কিশোরদের হাতে কায়েতপাড়া এলাকায় আনোয়ার হোসেন ও শিংলাব এলাকায় কিশোর সাইফুল ইসলামের হাতে তার মা দেলোয়ারা বেগম নিহত হন।
২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি দাউদপুরের কাজীরবাগ এলাকায় কিশোর বন্ধুদের হাতে খুন হয় মাহিম। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি খুনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পারভেজ আহম্মেদ জয়।
[33355]
২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর আয়েত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রিয়াংকা আক্তারকে গলা কেটে হত্যা করে কিশোর বখাটেরা। ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাঙ্গীর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাঈম হোসেনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করে তার কিশোর বন্ধুরা। একই বছরের ৪ জুন বন্ধুদের হাতে হত্যার শিকার হন মিঠাব এলাকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নেয়ামুল হক নাঈম। ২০১৪ সালের ৩ মে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৩নং ওয়ার্ডের মাদকাসক্ত কিশোর ছেলে আব্দুল কাদিরের হাতে তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম হত্যার শিকার হন। ২০১৩ সালের ১১ মে গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মৃত আমানউল্লার মেয়ে ও ভুলতা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শান্তা মনিকে পিটিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। আর এভাবেই গত ১০ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের হাতে ১৯ জন খুনের শিকার হয়েছেন।
তারাব পৌর যুবদলের আহ্বায়ক আফজাল কবির বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রূপগঞ্জে গত ১৫ বছরে নামে-বেনামে অসংখ্য কিশোর গ্যাং গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। তাদের দিয়ে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই, যা করানো হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা দেশেই আত্মগোপনে রয়ে গেছে। তারা আড়ালে থেকে এসব কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে। যারা এসব কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। তারাব পৌর বিএনপির সভাপতি তাশরিক হক ওসমান জানান, আমরা কোনো সংঘাত চাই না। বিগত দিনে এসব গ্যাং গ্রুপের হাতে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। সঠিক তদন্তের মাধ্যে এসব গ্যাং ও তাদের মদদদাতাদের বিচারের দাবি জানাই।
[33353]
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি রাছেল ভূঁইয়া জানান, গত ১৫ বছরে এসব কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। কিশোর অপরাধ কমাতে এসব গ্যাংয়ের নেপথ্যে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ কলামিস্ট ফোরামের মহাসচিব লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তা ছাড়া কিশোর ও যুবকদের মাদকের আগ্রাসন থেকে দূরে রাখতে হবে। একজন মাদকসেবীর পক্ষে সব অপরাধ করা সম্ভব। কিশোর ও যুবকদের কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শ দেন তিনি। তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তৎপর হওয়ার কথা জানান তিনি।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তরিকুল আলম জানান, ৪ মাস আগে আমি রূপগঞ্জ উপজেলায় যোগদান করেছি। যোগদানের পর থেকেই মাদক, ইভ টিজিং, বাল্যবিবাহসহ নানা অপরাধ রোধে অভিযান পরিচালনা করে এসেছি। মাদকের অপরাধে এ পর্যন্ত ৪ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দিয়েছি। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কিশোর গ্যাং একটি বড় সমস্যা। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদের রোধ করতে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চান তিনি।
[33343]
এসব বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম বলেন, মাদক, কিশোর গ্যাংসহ নানা অপরাধ দমনে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব অপরাধে কয়েকজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধী যে বা যারাই হোক, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। রূপগঞ্জে কোনো অপরাধীর জায়গা হবে না।