জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, বনে বনদস্যু আর জলে জলদস্যু আতঙ্ক নিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জেলেরা জীবনযাপন করছেন। আগের মতোই জলদস্যু আর বনদুস্যতায় ভরে গেছে সুন্দরবন আর সাগরপাড়। আতঙ্ক আর হতাশায় জেলেরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি আইন অনুযায়ী বন বিভাগের নিয়ম আর অনিয়ম মেনেই চলছে জেলেদের জীবনযাপন।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন চার-পাঁচ গুণ বাড়লেও জেলেদের জীবনমানের কোনো উন্নতি হয়নি। যদিও আবহমানকাল থেকেই এখানকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক জীবন ধারণের জন্য প্রধানত সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহসহ কাঁকড়া, মৎস্য আহরণের মতো পেশার ওপর নির্ভর করে আসছেন। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপকূলীয় সুন্দরবনসংলগ্ন জেলেদের জীবনে চলছে চরম আতঙ্ক ও হতাশায়। জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরতে গেলেই অপহরণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি অপহরণের ১০ দিন পার হলেও মুক্তি মেলেনি পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আলোরকোল শুঁটকিপল্লির ১৫ জেলের। গত ২৬ জানুয়ারি গভীর রাতে বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকা থেকে এই জেলেদের অপহরণ করে জলদস্যু মজনু বাহিনী। একেকজন জেলের মুক্তিপণ হিসেবে ধার্য করা হয়েছে ৩ লাখ টাকা করে। জিম্মি জেলেদের ফেরত পেতে ৪৫ লাখ টাকা দিতে হবে দস্যুদের। গত সোমবার বিকেলে অপহৃত জেলেদের মহাজন ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
তারা জানান, টাকা পরিশোধ না করায় জিম্মি জেলেদের নির্যাতন করা হচ্ছে। ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হচ্ছে না তাদের। ধার্য করা টাকা দ্রুত না দিলে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে জেলেদের। সুন্দরবনের অজ্ঞাত স্থান থেকে দস্যুদের মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে কান্নাকাটি করছেন জেলেরা। দস্যুদের জিম্মিদশা থেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নেওয়ার আকুতি জানানো হচ্ছে।
এদিকে টাকা না পেয়ে ছাড়তেও নারাজ দস্যুরা। আবার অতিরিক্ত মুক্তিপণ দাবি করায় তা পরিশোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না দরিদ্র জেলে পরিবারের পক্ষে। স্বজনকে ছাড়িয়ে আনতে মহাজনের বাড়িতে বাড়িতে ধরনা দিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। এই পরিস্থিতিতে জিম্মি জেলেরা আদৌ জীবিত ফিরে আসবেন কি না, ভেবে উৎকণ্ঠা বাড়ছে অপহৃতদের পরিবারে।
অন্যদিকে অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন মহাজনেরা। আতঙ্কে রয়েছেন দুবলারচরের চারটি শুঁটকিপল্লির প্রায় ১২ হাজার জেলে। মহাজনেরা বলছেন, চারটি শুঁটকিপল্লিতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। দুর্গম চরে তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় দস্যুরা এসে লুটপাট করলে তাদের কিছুই করার থাকবে না।
অপহৃত জেলে শ্যামনগর উপজেলার বন্যতলা গ্রামের শাহ আলমের দরিদ্র বাবা আবু তালেব মোবাইল ফোনে জানান, তাদের অভাবের সংসার। তিন বেলার খাবার জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় ৩ লাখ টাকা কোথায় পাবেন? ছেলেকে বুঝি আর ফিরে পাবেন না! এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
আলোরকোলের শুঁটকি ব্যবসায়ী আ. রাজ্জাক ও বাবুল সানা জানান, ১৫ জেলের মধ্যে আরাফাত ও জাহাঙ্গীর নামে তাদের দুই জেলে রয়েছেন। তারা দস্যুদের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রত্যেক জেলের মুক্তির জন্য ৩ লাখ টাকা করে দিতে হবে। এরকম হলে ছাড়া হবে না। জেলেরা বলেছেন, তাদের মারধর করা হচ্ছে। দ্রুত টাকা পরিশোধ না করলে তাদের হাত-পা ভেঙে ফেলা হবে।
আলোরকোলের শ্যামনগরের চাকলা জেলে সমিতির সভাপতি আ. রউফ মেম্বর ও রামপাল জেলে সমিতির সভাপতি মোতাসিম ফরাজি জানান, দস্যুদের সঙ্গে তারা একাধিকবার কথা বলেছেন। তাদের কথা হলো, ১৫ জেলেকে জীবিত ফেরত পেতে হলে প্রত্যেকের ৩ লাখ করে ৪৫ লাখ টাকাই দিতে হবে। এত টাকা শোধ করা ব্যবসায়ী বা পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
দুবলারচর ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেলে অপহরণের আট দিন পার হলেও আইনশৃঙ্খলা ক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যমান কোনো অভিযান দেখছি না। এতে আমরা হতাশ হচ্ছি। শুঁটকিপল্লিতে আতঙ্ক বাড়ছে। ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি কমাল আহমেদ বলেন, জিম্মি জেলেদের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানেরা প্রতিদিন তাদের মহাজনদের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করছে।
দস্যুরা বারবার তাদের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করছে। নতুন নতুন নম্বর দিয়ে কথা বলছে। এসব নম্বর র্যাব, কোস্ট গার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়েছে। তারা দেখছি-দেখব বলছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় দস্যুরা নতুন করে জেলে অপহরণেরও হুমকি দিচ্ছে। এতে জেলে-মহাজনেরা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
বাংলাদেশের জেলেদের বৃহত্তর একটা অংশের সাতক্ষীরা-খুলনার উপকূলে অনেকেরই থাকার মতো স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই। কোনোভাবে অন্যের জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। এমনও দেখা গেছে, নদী কিংবা সমুদ্রের পাড়ে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে কাটিয়ে দিতে হয় তাদের অনেক কাল। বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে এভাবেই জীবন চলে আসছে তাদের।
এ ব্যাপারে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, অধিকাংশ অপহরণের বিষয় আমরা জানতে পারি না। তবে বনের ভেতরে হঠাৎ করে জলদস্যু ও বনদস্যু বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরা দ্রুত পুলিশ, র্যাব ও বন বিভাগ মিলে যৌথভাবে বনের ভেতর অভিযান পরিচালনা করব।
আপনার মতামত লিখুন :