ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

রাজশাহীতে থামছে না পুকুর খনন

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজশাহী দুর্গাপুর উপজেলার তিনটি বড় বড় বিল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আংরারবিল ও ডাহারবিল অন্যটি ফলিয়ারবিলসহ আরো ছোট বড় বেশ কয়েকটি কৃষি ফসল উৎপাদন করা বিল রয়েছে। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর। সারা বছর ধান, গম, পাট ও বিভিন্ন সবজি জাতীয় কোনো না কোনো ফসল উৎপাদন করেন তারা। এ উপজেলার সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। এ দেশের বেশি অংশ সবজির চাহিদা মেটায় এ উপজেলার উৎপাদিত সবজি হতে।

কিন্তু হঠাৎ করেই উপজেলার যত্রতত্র ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তিন ফসলি, দুই ফসলি এবং চার ফসলি কৃষি জমিতে পুকুর খনন শুরু করে প্রভাবশালীরা। কোন ভাবেই ফসলি জমিতে পুকুর খনন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না।  এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এই উপজেলার ফসলি জমি। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্য দ্রব্যের সংকট দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও এলাকাবাসী ও কৃষক সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে প্রায় তিন থেকে চার হাজার পুকুর খনন করেছে প্রভাবশালীরা। তবে উপজেলা মৎস সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সমীক্ষায় আগে  এ উপজেলায় ছিল ৫হাজার ৯ শত ৫০টি। আর বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৫০টিতে। মৎস সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সমীক্ষাতেই এ উপজেলাতে দুইশত পুকুর বেড়েছে।

কিন্তু এলাকাবাসী ও কৃষকদের দাবী, গত ৫বছরে প্রায় কয়েক হাজার পুকুর বেড়েছে এ উপজেলায়। কিন্তু তা উপজেলা মৎস সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় সাথে সরেজমিনের উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যায়। তবে মৎস্য চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা অব্যাহত রয়েছে। আর যত্রতত্র পুকুর কাটায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকেরা সময়মতো আবাদ করতে পারছেন না। এর ফলে গত ৫ বছরে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে এ উপজেলায়। এতে করে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। আর প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকান্ড চললেও তা দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষকেরা। তবে উপজেলা প্রশাসনের দাবি  এ বছর উপজেলায় কোন পুকুর করা হচ্ছে না। দু’একটি এলাকা হতে অভিযোগ আসলে আমরা দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করছি।

উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের কৃষক জিন্নাত আলী জানান, সে  নারিকেল বাড়িয়া ও আংরার বিলের একজন কৃষক। তাদের এই বিলে আগে বছরে তিনটি ফসল হতো। এখন তারা একটি ফসলও ঠিকমতো তুলতে পারছেন না। কারণ ফসলের একটু দেরি হলেই জলাবদ্ধতার কারণে পানি এসে তা ডুবিয়ে দেয়। এই জলাবদ্ধতার কারণে শত শত বিঘা জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় ফসল করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের বেশি জমি তারা পুকুর কাটছে। কিন্তু তাদেরতো জমি অল্প। এখন বোরো আবাদ করবেন কিন্তু জমি তৈরি করতে পারছেন না তারা। প্রশাসনকে জানালে তাৎক্ষণিক বন্ধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না।

একই গ্রামের মন্টু আলী নামের আরেক কৃষক জানান, তার জমিটি অন্য একজনের পুকুরের পাশে। অন্য জমির মালিক তাদের জমি বেশি হওয়ায় তার জমিতে পুকুর কেটেছেন। কিন্তু তার জমি অল্প তাই সে চরম বিপদে পড়েছেন।

কৃষক জানান, যেভাবে পুকুর কাটা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে এক সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। পুকুর কাটার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে তারা ঠিকমতো আবাদ করতে পারছেন না। আর যদি আবাদ না হয় তাহলে তো শতভাগ খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবেই। বর্তমানে তিন ফসলি জমিতে প্রচুর পুকুর কাটা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে জানালে তারা এসে ভেকুর ব্যাটারি নিয়ে যাচ্ছে। এতে ২-১ দিনের জন্য বন্ধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না। যদি বন্ধ না হয় তাহলে তিন ফসলি জমির আরও খুব ক্ষতি হবে। তাই প্রশাসনের স্থায়ীভাবে পুকুর খনন বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়াও পুকুর খনন বন্ধের প্রতিবাদ করলে তারা ভয়ভীতি দেখায় ও হুমকি দেয়।

অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত দুর্গাপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তানজিমুল ইসলাম জানান, দুর্গাপুরে মৎস্য চাষে অত্যন্ত সমৃদ্ধ উপজেলা। এখান কার্ফ জাতীয় মাছ বড় করা হয়। এখান থেকেই প্রথম রুই ও কাতল মাছ বড় করা হয়। এখানকার চাষিরা মাছ চাষ করে বেশ লাভ করতে পারছে। ৫ বছর আগে পুকুরের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯ শত ৫০টি। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ১৫০টি। মাছ চাষ বেশ হচ্ছে কারণ মাছ চাষ বেশ লাভজনক। এ উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ  উৎপাদন হয়। যা উপজেলা ও জেলার চাহিদা মিটিয়ে মাছ বাহিরে যাচ্ছে। এমনকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। কারণ দুর্গাপুর উপজেলার মাছ বেশ স্বাদযুক্ত ও রং অনন্য। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে। এ জন্য মাছ বিক্রির জন্য চাষিদের বেগ পেতে হয় না। অন্যান্য চাষের সাথে তুলনা করলে মাছ চাষ খুব লাভজনক। কিন্তু পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের দিকে খেয়াল রেখে কৃষকদের তিন ফসলি জমিতে পুকুর কাটা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকতা সাহানারা পারভীন লাবনী জানান, উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে এ কথা স্বীকার করে বলেন, কৃষি বিভাগের এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে অল্প আবাদি জমিতে অধিক ফসল ফলানো যায়। প্রতি বছর রাস্তা-ঘাট, ঘড়-বাড়ি, বিভিন্ন স্থাপনা, ও পুকুর কাটায় এই আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

লাবনী বলেন, ভালো জমিতে বিশেষ করে তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে কেউ পুকুর খনন করতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। কিছুটা কমলেও যাতে ভালো জমিতে উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাত, রোগ প্রতিরোধক জাতগুলোর ব্যবহার কীভাবে করা যায় কৃষি বিভাগ সে ব্যাপারে কৃষকের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।