গাজীপুর মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকায় মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতা।
ঘটনায় ‘জড়িত’ সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ হোসেন রাসেল, সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ পলাতক আওয়ামী নেতা ও হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা।
এ ঘটনায় উত্তাল গাজীপুরজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। জেলাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে, যেকোনো সময় বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের টহল ও নজরদারি বাড়িয়েছেন।
গতকালও ছাত্রদের জমায়েত লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। এতে মুবাশশের হোসেন নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী সড়কে এ ঘটনা ঘটে বলে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রিয়াজ উদ্দিন জানান।
এর আগে শুক্রবার রাতে মোজাম্মেল হকের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর চালানোর সময় অন্তত ১৫ জনকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।
বিগত সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, রাসেল ও জাহাঙ্গীর এবং আওয়ামী দোসরদের হামলার প্রতিবাদ ও অবিলম্বে বিচারের দাবিতে দিনভর উত্তাল ছিল গাজীপুর।
গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে দুপুরে মহানগরীর রাজবাড়ী মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
এ সমাবেশে বিকেলে অংশগ্রহণ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম।
সমাবেশে একাত্মতা ঘোষণা করতে যান পুলিশ কমিশনার। পুলিশ কমিশনার সেখানে পৌঁছালে প্রথমে শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দিতে শুরু করেন। তখন পুলিশ কমিশনার সেখান থেকে চলে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এলে তিনি কথা বলার সুযোগ পান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, খুনি হাসিনার সন্ত্রাসীরা এখনো গাজীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা শহরের রাজবাড়ি মাঠ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামেন রাজবাড়ি সড়কে এসে অবস্থান করে রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
এদিকে হামলার ঘটনায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহারে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার।
গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে কথা বলেন মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান।
গতকাল বিকেলে গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে ওসি মোহাম্মদ আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহার এবং ক্ষমা চান মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান।
শুক্রবার রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সম্মিলিত পরিকল্পিত হামলার সময় ঘটনাস্থল থেকে বারবার পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে সদর থানার ওসির বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীরা ওই পুলিশ কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করেন। কর্মসূচির পর জমায়েত লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে: গাজীপুর শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ি এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুবাশশের হোসেন (২৬) নামের সক্রিয় এক সদস্যকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শহরের জোর পুকুরপাড়ের দিক থেকে মোটরসাইকেলে করে এসে গুলি করে পালিয়ে যায় তারা।
ঘটনার পরপরই মোবাশশের হোসেন জানান, একটি মোটরসাইকেল থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তার ডান হাতে গুলি লেগেছে।
তিনি গাজীপুর মহানগরের হারিনাল দক্ষিণপাড়া এলাকার আলী আহমেদের ছেলে। তাকে উদ্ধার করে গাজীপুরের শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে গাজীপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস এবং অপারেশন ডেবিল হান্টকে পর্যবেক্ষণের ঘোষণা দিয়ে গতকালের মতো কর্মসূচি স্থগিত করা হয় বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এ তথ্য জানান।
এর আগে সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থল গাজীপুর সদর উপজেলার রাজবাড়ি মাঠে জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা।
গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম রাজবাড়ি সড়কে আসেন।
সেখানে বক্তব্য রাখেন হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। বিকালে সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল গাজীপুর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাজবাড়ি সড়কের পাশে আওলামী লীগের কার্যালয়ের সামনে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ম্যুরাল ভাঙচুর করে। গত ৪ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
বিকালে রাজবাড়ি সড়কে বিক্ষোভ সমাবেশে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, এ দেশটা আমাদের, এ দেশের নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা পুলিশকে সহযোগিতা করব। তার মানে এই নয় যে, পুলিশ মামলাবাণিজ্য করবে। ১৫ জনকে ধরেছে আর পরদিন তাদের জামিন দিয়ে দেবে। তিনি বলেন, আ ক ম মোজাম্মেল হচ্ছেন গণহত্যাকারী। তিনি আওয়ামী লীগের দোসর।
আমরা ছাত্রদের নিয়ে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব। ১৭ বছর ধরে যারা নিপীড়ন চালিয়ে এই গাজীপুরকে সন্ত্রাসের আঁতুরঘরে পরিণত করেছে, তাদের অপারেশন ডেভিল হান্টের মাধ্যমে ধরতে হবে।একটাও যেন বাদ না যায়।
সারজিস আলম বলেন, ‘খুনি হাসিনার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো গাজীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরা এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের যোদ্ধাদের হুমকি দিচ্ছে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ইন্টেলিজেন্স যদি আজকে রাতের মধ্যে গতকালের হামলায় জড়িত খুনি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে না পারে, তাহলে আমাদের তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।’
এর আগে সকাল থেকে গাজীপুর শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শহরের রাজবাড়ি সড়ক ও রাজবাড়ি ময়দানে এসে জড়ো হয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেন।
গাজীপুর মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকায় পরিকল্পিতভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের ওপর হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে না পাঠানো পর্যন্ত রাজপথে অবস্থানের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের কোথাও আমাদের কোনো সহযোদ্ধার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে পুরো বাংলাদেশ আবার নতুন করে জেগে উঠবে। আমরা প্রয়োজনে যেমন ঢাকায় নামতে পারি, যেমন গাজীপুরে আসতে পারি, আমরা প্রয়োজনে দেশের প্রতিটি জেলায় যেতে পারি।
আমরা অভ্যুত্থানে দেখিয়েছি, এ দেশের ছাত্র-জনতা সঠিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ধৈর্য ধরেছে। কিন্তু একটা ধৈর্যের বাঁধ আছে। এ দেশে প্রশাসন থেকে শুরু করে যারা কাজ করছেন, তারা যদি আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেন, তাহলে দেশে নতুন আরেকটি বিপ্লব দেখতে হবে।’
এর আগে শুক্রবার রাতে গাজীপুর মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকায় দেশ ছেড়ে পলাতক সাবেক আ ক ম মোজাম্মেল হকের পৈতৃক বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা ঘটনাস্থলে গেলে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালান।
হামলায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এ হামলার প্রতিবাদে রাতেই গাজীপুর মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তিনি গণমাধ্যমকে সঠিক সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ করেন।
সমাবেশে সারজিস আলম অভিযোগ করেন, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা যখন নিরীহ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছিল, বারবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পুলিশকে খবর দিলেও তারা সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে আসেনি। ঘটনা ঘটার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর তারা ঘটনাস্থলে আসে।
অন্যদিকে, গাজীপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর খুনি আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীর ও আওয়ামী দোসরদের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে বেলা ১১টার দিকে শহরের রাজবাড়ি মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির গাজীপুর জেলা ও মহানগর কমিটি।
এতে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সংগঠক অ্যাডভোকেট আলী নাসের খান, কেন্দ্রীয় সদস্য এম এম শহিদ, গাজীপুর সদর থানা কমিটির প্রতিনিধি খন্দকার আলামিন, কালিয়াকৈর থানার প্রতিনিধি সুমন মিয়া, গাছা থানার প্রতিনিধি মাস্টার আনিসুর রহমান, টঙ্গী পশ্চিম থানার প্রতিনিধি নাবিল প্রমুখ।
যেভাবে হামলা করা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর: ঢাকার ধানমন্ডিতে ভাঙচুরের ঘটনার পর গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা প্রচার করেন যে কোথাও কোনো প্রকার ভাঙচুর না করার জন্য। সন্ধ্যার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা খবর পান যে ধীরাশ্রম এলাকায় পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা গণহত্যা মামলার আসামি আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট করা হচ্ছে।
ভাঙচুর ও লুটপাট ঠেকাতে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় মাইকে ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা, রামদাসহ ধারালো অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা চালায়।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বাড়ির ছাদে নিয়ে বেধড়ক মারধর ও কুপিয়ে জখম করে। যেসব শিক্ষার্থী আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে যান, তারাও হামলার শিকার হন।
আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জনকে ভর্তি করা হয়। এদিকে হামলাকারীরা মেবাইল ফোনে লাইভে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধরের ভিডিও ধারণ করে প্রচার করে। আওয়ামী লীগের পেইজে আপলোড করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকায় শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙচুরসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর হওয়ার পর গাজীপুরে আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িটি সশস্ত্র পাহাড়া দিচ্ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি জানতেন না শিক্ষার্থীরা। পরে তারা ভাঙচুরের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন।
সমাবেশস্থলে পুলিশ কমিশনার: বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সমাবেশ চলাকালে বিকালে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান সমাবেশস্থলে যান এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আমলে আমাকে অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছিল। আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে আমিও আন্দোলন করেছি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের শরীরে যে ফ্যসিবাদবিরোধী রক্ত, আমার শরীরেও একই রক্ত।’ গত রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চান। যারা শিক্ষার্থীদের ওপর আঘাত করেছে, তাদের প্রত্যেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হবে। যেসব পুুলিশ দায়িত্বে অবহেলা করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমাবেশে তিনি সদর থানার ওসি মোহাম্মদ আরিফুর রহমানকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, যেসব পুলিশ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত করবে, তাদের পুলিশের চাকরি করতে দেওয়া হবে না। এতদিনে যে ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়েছে, সেই ফ্যাসিবাদ থেকে পুলিশকে বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, গত ১৭ বছর যরা আপনাদের অন্যায়ভাবে নির্যাতন করেছে, তারা আবারও এ দেশের ওপর জুলুম করেছে, এখনো তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে।
তাদের এই মাথাচাড়া দেওয়া কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ধীরাশ্রমে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি শিক্ষার্থীদের জানান।
গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান।
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছি। হামলাকারী কাউকে ছাড়া হবে না, প্রতিটি হামলার জবাব দেওয়া হবে। যেসব পুলিশ রেসপন্স করতে দেরি করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
গতকাল শনিবার বিকেলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ি সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান এসব কথা বলেন। এর আগে দুপুরে নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজবাড়ী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
নাজমুল করিম খান বলেন, ‘আমি শুনেছি, আমার ওসি দুই ঘণ্টা পর আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
আমি এখানে দাঁড়িয়ে বললাম, তাঁকে সাসপেন্ড (বরখাস্ত) করব। আমি বলতে চাই, যারা এই ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত করেছে, তাদের পুলিশে চাকরি করতে দেওয়া যাবে না।
গত ১৭ বছর ধরে যারা অত্যাচার করেছে, দেশের ওপর জুলুম করেছে, তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো মাথাচাড়া বরদাশত করা হবে না। ইতিমধ্যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ রাতে চিরুনি অভিযান চালানো হবে। ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দমন করার জন্য “অপারেশন ডেভিল হান্ট” পরিচালনা করা হবে।’
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের সময় সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, গতকাল শুক্রবার রাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে লুটপাটের খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা বন্ধ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকালে শহরের রাজবাড়ির মাঠ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের সড়কে বসে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেখানে গিয়ে মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান হামলার ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। এরপর বিকেল ৫টার দিকে মিছিল করতে করতে নেতাকর্মীরা ফিরে যান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও আহত শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ঢাকার ধানমন্ডিতে ভাঙচুরের ঘটনার পর তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করেন যে কোথাও ভাঙচুর হলে তাদের জানাতে।
গতকাল রাতে তাদের কাছে খবর আসে, ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে। এটি শোনার পর লুটপাট বন্ধ করতে শিক্ষার্থীরা সেখানে গিয়ে হামলার শিকার হন।
হাসপাতালে সারজিস ও হাসনাত আব্দুল্লাহ: গত শুক্রবার রাত ৩টার দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে এবং তাদের খোঁজখবর নিতে রাতেই গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন।