বান্দরবান বন গিলে খাচ্ছে রহমান-সুলতান সিন্ডিকেট

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫, ০১:৪৮ পিএম

বান্দরবান বন গিলে খাচ্ছে রহমান-সুলতান সিন্ডিকেট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ থেকে বান্দরবান বন বিভাগে যোগদান করেন। 

সাবেক সিএফ বিপুল কৃষ্ণ দাশের আস্থাভাজন এই বন কর্মকর্তা এখন ভোল পাল্টিয়ে বর্তমান বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমের আস্থা অর্জন করেছেন। তার আরেক আস্থাভাজন সুলতান মাহমুদ হাওলাদার টিটু, রেঞ্জ অফিসার, সদর রেঞ্জ। বান্দরবান বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তার হিসেবে যোগদান করেন।

সাবেক বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশের আস্থাভাজন হিসেবে বালাঘাটা এসএফএনটিসি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পদটিও বাগিয়ে নেন। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মিলে একটি সিন্ডিকেট করে পুরো বান্দরবান বন বিভাগকে গিলে খাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে বান্দরবান বন বিভাগে হরিলুট। 

খোদ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুর রহমানের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে চলছে গাছ পাচার, সংরক্ষিত বন উজাড়, পারমিটবিহীন গাছ কাটা, পাচার, বদলি নীতিমালাবহির্ভূত পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বাগান থেকে জোত পারমিট বান্দরবান নং-২৪/২০২৩-২৪ মূলে ১৫ হাজার ঘনফুট কাঠের পারমিট ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে টিপি (চলাচল পাস) মূলে ইস্যু হয়েছে ৫৫০০ ঘনফুট। ডিপোতে থাকার কথা ৬৫০০ ঘনফুট; এর মধ্যে ডিপোতে চেক হয়েছে ৪৫০০ ঘনফুট। ডিপোতে চেক হয়নি ২০০০ ঘনফুট। এক্ষেত্রে বাগানে এখনো স্টক থাকার কথা।

আদালতে মালামাল জব্দের নির্দেশনা থাকায় ৬৫০০ ঘনফুট কাঠ বন বিভাগের হেফাজতে থাকার কথা। জোতের কাগজ অনুযায়ী ওই কাঠগুলোর কোনো হদিস নেই। 

বান্দরবান সদর রেঞ্জ অফিসার সুলতান মাহমুদ হাওলাদার টিটু অন্য টিপির আড়ালে লট আকারে পাচারে সহযোগিতা করেছে বলে সূত্রে জানা গেছে। না হলে ইস্যুকৃত কাঠের বিপরীতে যে টিপি দেওয়া হয়েছে, অবশিষ্ট কাঠ ডিপোতে মজুত থাকার কথা ছিল। 

কিন্তু সদর রেঞ্জে কাগজে-কলমে কাঠ আছে বাস্তবে নাই বা জব্দ করে নাই। ওই কাঠ রাতের আঁধারে বা ভুয়া টিপির মাধ্যমে সদর রেঞ্জ অফিসার টিটু কাঠ পাচারের সহযোগিতা করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বান্দরবান বন বিভাগে ঘুষের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ঘুষের হারের মধ্যে রয়েছে, টিপি প্রতি ১৩ হাজার টাকা। এ থেকে ডিএফও ২৩০০ টাকা, এসিএফ ৬০০ টাকা, রেঞ্জ অফিসার ৮০০ টাকা, অফিস সেকশন ৬০০ টাকা, ফরেস্টার ২৬০০, ফরেস্টার গার্ড ২৫০০ টাকা। স্টক চেকিং প্রতি ঘনফুটে মোট ৯ টাকা। এ থেকে রেঞ্জ অফিসার ২ টাকা, ডিএফও ৬ টাকা, অফিস ১ টাকা।

জোত পারমিটে নেওয়া হয় প্রতি ঘনফুটে ৫৫ টাকা। এর মধ্যে ডিএফও ১৭ টাকা, সিএফ ৫ টাকা, রেঞ্জ অফিসার ২০ টাকা, স্টাফ ও ফরেস্টার ৫ টাকা, অফিস ও অন্যান্য ৮ টাকা হারে ভাগবাটোয়ারা হয়।

অন্যদিকে বান্দরবান বন বিভাগে একটি বিশেষ টহল বাহিনী গঠন করেছেন। এই টহল বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বেও রয়েছে সুলতান মাহমুদ টিটু। বিশেষ টহল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন ফরেস্টার নাজমুল ও জুয়েল। 

তাদের মাধ্যমে পুরো বান্দরবান বন বিভাগে চাঁদাবাজি করে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। বিশেষ বাহিনী গঠন হলেও দীর্ঘদিন কোনো প্রকারের মামলা, কিংবা অবৈধ কাঠ আটক করা হয়নি বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে। 

পুরো বান্দরবান সদর এলাকায় পারমিটবিহীন গাছ কাটার হিড়িক পড়লেও বিশেষ বাহিনী কর্তৃক আটক হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুর রহমান পুরো বন বিভাগ এই দুই ফরেস্টারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। 

সুলতান মাহমুদ টিটু ফরেস্টারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে এক বছর পোস্টিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও প্রায় ২ বছর হতে চলছে, তবু বদলি করেনি তাকে। 

আর এই অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য সুলতান মাহমুদ টিটু ফরেস্টার কর্তৃক বান্দরবান  সদর উপজেলায় পারমিটবিহীন গাছ উজাড় হচ্ছে আর টাকা যাচ্ছে ডিএফও রহমানের পকেটে। যার প্রমাণ সদর উপজেলায় তদন্ত করলে পাওয়া যাবে। 

সূত্র বলছে, বদলি বাণিজ্য আর ঘুষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার এই কার্যালয়। ফরেস্টারদের রেঞ্জ ও স্টেশনে পোস্টিং দিতে নেওয়া হয়েছে ১০-১২ লাখ টাকা। আর ফরেস্ট গার্ডদের রেঞ্জ ও স্টেশনে পোস্টিংয়ে নেওয়া হয় ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা।

পোস্টিংয়ে টাকা না দিলে তাদের পোস্টিং দেওয়া হয় থানচি ও সেকদু দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে। প্রমাণস্বরূপ ওই বন বিভাগের ফরেস্ট গার্ড নাছিরুল আলম চৌধুরী দুই বছর ১১ মাস পূর্বে বান্দরবান বন বিভাগে সুয়ালগ চেক স্টেশনে নিয়মবহির্ভূত এক বছর ছয় মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার সময় নাছিরুল আলমের বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারীর অভিযোগ উঠলে তড়িঘড়ি করে তাকে সেকদু রেঞ্জে বদলি করেন। 

বর্তমানে নিয়মবহির্ভূতভাবে সদর রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। যদিওবা স্টেশন পোস্টিংয়ের মেয়াদকাল এক বছর করে ধরা হয়। কিন্তু এখানে তার উল্টো ঘটে। 

এখানেই শেষ নয়, ৪ মাসের মাথায় নাসিরুল আলম, ফরেস্ট গার্ডকে চলতি কাজ চালানোর কথা বলে পত্রমূলে সদর রেঞ্জে অর্ডার করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। যেখানে স্টেশন থেকে সদর রেঞ্জে আট বছরের মধ্যে চাকরির নীতিমালা নেই বলে জানান। 

সাধারণ কর্মচারীরা টাকার বিনিময়ে নাছিরুল আলমের ক্ষেত্রে নিয়ম পাল্টে যায়। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বন সংরক্ষকের বদলি তালিকায় নাছিরুল আলম এক নম্বরে থাকলেও তার পরের ১০ জনকে বদলি করেছেন। 

কিন্তু বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সুপারিশের কারণে নাছিরুল আলমকে বদলি করেননি বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম। এই বন বিভাগে প্রতিমাসে যে পরিমাণ জোত পারমিট ইস্যু হয় তার প্রতি ঘনফুটে বন সংরক্ষককে দিতে হয় ২০ টাকা। যা আদায় করেন রেঞ্জ অফিসারদের মাধ্যমে। 

এদিকে, বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানের ডিএফও আবদুর রহমান উপকূলীয় বনবিভাগের দায়িত্বে থাকাকালে মহেশখালীসহ উপকূল এলাকায় বনায়নের নামে সুফল ও গ্রিন বেল্টের নামে বিপুল অর্থ লোপাট করেছিলেন। 

এ ছাড়াও রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ টিটু এর আগে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে থাকাকালীন অনেক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও অজ্ঞাত কারণে পার পেয়ে যান।

বান্দরবান বন বিভাগে সদর রেঞ্জ, বেতছড়া, টংকাবতী, রুমা, পাইন্দু, থানছি, সেবরদু ও সুয়ালক চেক স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে থানচি রেঞ্জে ৮২ হাজার একর বনভূমি সংরক্ষিত রয়েছে যাতে প্রাকৃতিক গাছ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা একেবারেই বৃক্ষশূন্য হতে চলেছে। 

বিভিন্ন ভুয়া পারমিটের অন্তরালে দিনরাত নির্বিচারে গাছ কাটা অব্যাহত আছে। বান্দরবান বন বিভাগের অবশিষ্ট বনাঞ্চল রক্ষায় অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। 

তাদের মতে, যেখানে সারা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমানোর জন্য বৃক্ষ রোপণের জন্য চেষ্টা চলছে, আর এই বন কর্মকর্তা পরিবেশ রক্ষাকারী গাছপালা ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বন, প্রকৃতি, পরিবেশ ও বনভূমি ধ্বংসকারী এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সচেতন মহলের।

এ ব্যাপারে সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ টিটু বক্তব্য নিতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইলে বক্তব্য দিবে না বলে রূঢ় আচরণ করেন।

এ ব্যাপারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরদুর রহমানের বক্তব্য জানতে একাধিক বার ফোন করার পরেও রিসিভ করেননি।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!