ভারত-পাকিস্তান দেশ বিভক্তির সময় পাক-ভারত নীতিমালা মেনেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিলো। ভারতের পতাকা রাঙামাটিতে উত্তোলন করেছিল আর বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এই পতাকা উত্তোলনটাই অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে কাপ্তাই বাঁধ। আর এখান থেকেই সবকিছুর সূত্রপাত। আমরা যেখানে নই, সেখানে ফেলে দেওয়া হলো বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক সাংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে এখন অনেক ভুঁইফোড় সংগঠন গর্জে উঠছে। তারা নিজেদের কে সত্য বলে দাবি করছে। কি সত্য আপনারা? আপনারা তো এখনো নিজেদের রূপরেখাই দিতে পারে নাই। আপনারা চান আঞ্চলিক পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন, কিভাবে আনবেন আপনারা পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। সে রূপরেখাই তো দিতে পারেন নি। আমরা তো দিয়েছি। এখন আমাদের আন্দোলন চুক্তি বাস্তবায়নের। আপনারা তো কিছুই বলতে পারেন না, শুধু বলেন পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন। কি করেছেন? কি পেয়েছেন? শুধুই বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছেন। অনেকেই আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখাতে চায়। আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নই। আমরা পার্বত্য অঞ্চলকে আলাদা রাষ্ট্রেও পরিনত করতে চাই না, জনসংহতি সমিতি কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলে না। আমাদের চাওয়া দেশ বিরোধী নয়, আমরা দেশের অংশ বিভক্ত করতে চাই না। আমরা চাই পাহাড়ের নিপিড়ীত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা চাই শান্তি চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাঙামাটি শহরের কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়াম মাঠে পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫৩তম প্রতিষ্টাবার্ষিকী উপলক্ষে `পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করুন` এই প্রতিপাদ্যে গণসমাবেশ ও আলোচনা সভা করে পাহাড়ি আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি।
এর আগে সকালে গিরি সুর শিল্পী গোষ্ঠীর পরিবেশনায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। পরে জাতীয় সংগীত ও দলীয় সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে বেলুন উড়িয়ে আলোচনা সভার উদ্বোধন করেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ছাত্র বিষয়ক সহ-সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, ২৬ বার শাসক গুষ্ঠির সাথে বৈঠকের পর পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছে। এই শান্তি চুক্তি রাজনৈতিক সমস্যা, কোন অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। এই চুক্তি অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে কোন গুষ্টি কিংবা জাতি নয়, দাউ দাউ করে পুরো জাতি-গোষ্ঠী ও পার্বত্য আঞ্চল জ্বলবে।
অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য গুনেন্দু বিকাশ চাকমার সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা কে এস মং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রামের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি ভবতোষ দেওয়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যাসহ আরও অনেকে।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সৃষ্টি। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূরনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বিগত ৫৩ বছর ধরে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করে আসছে।
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে চারদফা সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৭২ সালে জুম্ম জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের যে নূতন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছিল তা আজো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে অব্যাহত গতিতে বেগবান রয়েছে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোন সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ফলে চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে ব্যাপক সামরিকায়ণ করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের নীতি বলবৎ রয়েছে। `ভাগ করো শাসন করো` উপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সরকারের বিশেষ মহলের মাধ্যমে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল, সুবিধাবাদী ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে দিয়ে এবং তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :