মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের জন্য নির্মিতব্য দেশের প্রথম ও একমাত্র বিশেষায়িত মেডিকেল রিসোর্ট ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’।
১৯৯৬ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ থেকে ১২ ভাগ কাজ হয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উদ্বোধনের কথা থাকলেও হঠাৎ করে কাজ বন্ধ হওয়ায় প্রকল্পটি অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তবে কী কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে তার সঠিক উত্তর দিতে পারছেন না প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, প্রবাসী অধ্যুষিত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেখে যাওয়া নিঃসঙ্গ পিতা-মাতাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের সামান্য খরচে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা সুবিধা, চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, ধর্মচর্চাসহ লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক শ্রীমঙ্গলে অবসর প্রকল্প করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এরই অংশ হিসেবে ২০০১ সালের প্রথমদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে ফিনলে টি কোম্পানির ৫.৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
অধিগ্রহণকৃত জমিতে বৃদ্ধাশ্রম অবসর প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎকালীন সময়ে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ কোটি টাকা।
গণপূর্ত বিভাগের অধীনে এ প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাউন্ডারি দেয়াল ও মাটি ভরাট করে ভবন নির্মাণের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়।
কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে এটা নিয়ে আবার কাজ শুরু করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।
এরই মধ্যে সরকার এক নীতিমালায় ৬০ বছর বা তদূর্র্ধ্বদের জ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বীকৃতি প্রদান করে।
নীতিমালায় প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য, আবাসন, যানবাহনে আসন সংরক্ষণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
যার ফলে ‘অবসর’ প্রকল্পটি আধুনিকায়ন করে মেডিকেল রিসোর্ট করার লক্ষ্যে সরকার নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার নামকরণ করা হয় ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’।
২০১৭ সালে ওই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় রাজধানীর ‘চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিল, শ্রীমঙ্গলের নির্মিতব্য মেডিকেল রিসোর্টটি গতানুগতিক কোনো বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস নয়।
প্রবীণ নিবাসে সারা জীবনের জন্য বাবা-মাকে রেখে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ মেডিকেল রিসোর্টে এটি সম্ভব নয়।
এখানে যেসব ষাটোর্ধ্ব জ্যেষ্ঠ নাগরিক আসবেন তারা চাইলে চুক্তিকৃত মেয়াদের মধ্যে বা মধ্যবর্তী সময়ে তাদের বা পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী অন্য কোথাও যেতে পারবেন।
এখানে পুরুষ এবং নারীদের জন্য পৃথক ব্লক থাকবে। এ ছাড়া প্রবীণ স্বামী-স্ত্রীর জন্য থাকবে বিশেষ কটেজ, পাঠাগারে বই পড়া, ওয়াকওয়েতে হাঁটা কিংবা বাগান করার শখও পূরণ করতে পারবেন ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’ মেডিকেল রিসোর্টের বাসিন্দারা।
প্রকল্পটিতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মেডিকেল রিসোর্টের যে প্ল্যান ও ডিজাইন করা হয়েছিল, তাতে উল্লেখ ছিল বিশ্বমানের এ মেডিকেল রিসোর্টে থাকবে ১৬টি ভবন।
যার মধ্যে ১০টি ডুপ্লেক্স ভবনে থাকবে ১০০টি নিরাপদ আবাসন, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুরুষ ও মহিলা নিবাসীদের জন্য দুটি হোস্টেল।
এ ছাড়া একটি মেইন ব্লক ভবনে থাকবে গেস্টরুম, রেস্টুরেন্ট, কর্মরত চিকিৎসক ও সেবীকাদের জন্য আলাদা আবাসিক ভবন, পাঠাগার, ওয়াকওয়ে, বাগান, ফোয়ারা, বিনোদনসামগ্রী, খোলা মাঠ, জলরাশি আর অবারিত সবুজের সমারোহ।
প্রয়োজন অনুসারে দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’ মেডিকেল রিসোর্ট থেকে তাদের সব সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের অসুস্থতা, আহত, ডিইমেনশিয়া বা বয়সের সঙ্গে আসা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ অবসরকেন্দ্রটি সহায়তা করবে।
ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ নাগরিকরা এখানে থাকার সুযোগ পাবেন। ‘ফি’ নির্ধারিত হবে অবসর গ্রহণের ব্যাপ্তির ওপর নির্ভর করে। কোনো জ্যেষ্ঠ নাগরিক এখানে এক সপ্তাহ থাকলে এক ধরনের ‘ফি’ হবে আর দীর্ঘদিন থাকলে আরেক ধরনের ‘ফি’ হবে।
সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্নের পর ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ‘অবসর- আমার আনন্দ ভুবন’ মেডিকেল রিসোর্টটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।
এর মধ্যে কিছু রুটিন কাজ সম্পাদনও হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে প্রকল্পের ‘মেইন ব্লক’ ও ‘ক্লিনিক’ নির্মাণ কাজ শেষ করে উদ্বোধন করার কথাও ছিল।
তবে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পুনরায় কাজ শুরু হলেও কিছুদিন কাজ করার পর মেডিকেল রিসোর্টের কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় প্রকল্পের এটার ভেতরে থাকা রড, ইট-পাথর, কাঠসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী অজ্ঞাতরা নিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।
এলাকাবাসী জানান, এটার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা লোকজন থাকার পরও কীভাবে নির্মাণাধীন ভবন থেকে কে বা কারা বড় বড় রড কেটে নিয়েছে। যদি প্রকল্পের কাজ শেষ না করা হয়, তাহলে সরকার কেন জমি অধিগ্রহণ করে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে বাউন্ডারি ওয়াল করল। আবার প্রকল্পের ১০ থেকে ১২ ভাগ কাজই বা কেন করল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর পৃথিবী পাল বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তবে কী কারণে বা কেন বন্ধ রয়েছে তা আমরা জানি না। প্রকল্পের প্রকৌশলী এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সুয়েব হোসেন চৌধুরী বলেন, শ্রীমঙ্গলে মনোরম পরিবেশে ৫.৬ একর ভূমিতে নির্মাণাধীন ‘অবসর-আমার আনন্দ ভুবন’ নামে মেডিকেল রিসোর্টের কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল। কী কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে তা আমি জানি না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কাজ হচ্ছে। এ কাজের সঙ্গে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোসা. শাহীনা আক্তার বলেন, কী কারণে কাজ বন্ধ হয়েছে তা আমিও জানি না। তবে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখি এটা কী অবস্থায় আছে। প্রকল্পটির যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য স্থানীয় ইউএনওকে নজর দেওয়ার জন্য বলে দিচ্ছি।
আপনার মতামত লিখুন :