জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর প্রাতিষ্ঠানিক ইমেজ সংকটে ভুগছিল পুলিশ। তখন নিজ জেলার মানুষের আস্থা ফেরাতে অনন্য এক উদ্যোগ নেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ‘নাইট পেট্রোল’ থানা পুলিশের নিয়মিত কাজ হলেও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নাইট পেট্রোল চালুর পর সর্বত্র প্রশংসিত হয় জেলা পুলিশ।
প্রশংসিত হন তিনি। চলতি বছর ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের দায়িত্বভার গ্রহণের পর জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়, জেলা গোয়েন্দা পুলিশসহ জেলা পুলিশের আওতাধীন ১৭টি থানা এলাকায় প্রতিরাতে একযোগে এই কার্যক্রম শুরু করে।
জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, জেলার প্রতিটি গ্রামে; অলিতেগলিতে আমরা এই মেসেজ পৌঁচ্ছে দিতে চাই, আমরা (পুলিশ) জেগে আছি আপনারা নির্ভয়ে ঘুমান। তিনি আরও বলেন, পুলিশের পক্ষে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আমার পুলিশ যখন রাতবিরাতে অলিতেগলিতে সরব থাকবে তখন অপরাধীরা অপরাধ করতে শতবার চিন্তা করবে। আমরা যেমন সাধারণ মানুষকে নির্ভয়ে ঘুমানোর মেসেজ দিতে চাই ঠিক একইভাবে যারা অপরাধী তাদেরকেও মেসেজ দিয়ে চাই, সাবধান অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) এ এন এম ওয়াসিম ফিরোজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) শেখ মো. সেলিম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিল্পাঞ্চল ও ডিবি) রাসেল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সীতাকুণ্ড সার্কেল) মো. লাবীব আবদল্লাহ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পটিয়া সার্কেল) মো আরিফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ, সি. সহকারী পুলিশ সুপার (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) মো. নুরুল আমীন, সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) মো. সোহানুর রহমান সোহাগ নিজ নিজ এলাকায় নাইট পেট্রোল পরিচালনা করেন।
সবার সাথে সমন্বয় করে সশরীরে নাইট পেট্রোলের নেতৃত্ব দেন পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জেলা পুলিশের রাতের অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন এই প্রতিবেদক।
জেলা পুলিশের রাতের অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন জেলার বাসিন্দারা। তারা বলেন, জেলা পুলিশের নাইট পেট্রোলের কারণে থানা পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। পটিয়ার বাসিন্দা আবুল ফয়েজ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক বেশি নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেছিল পুলিশ।
৯৯৯-এ কল করার পরও পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া যেত না। কিন্তু জেলা পুলিশ সুপার নাইট পেট্রোল শুরু করার পর থানা পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাক্টিভ। শুধু অপরাধ নিয়ন্ত্রণই নয় জেলা পুলিশের নাইট পেট্রোলিংয়ের কারণে পুলিশ সুপারের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা। তারা তাদের অভিযোগ পুলিশ সুপারকে সরাসরি বলার সুযোগ পাচ্ছেন।
জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, জেলা পুলিশের নাইট পেট্রোলিং শুরু করার পর মহাসড়কে সংঘটিত অপরাধ যেমন কমেছে ঠিক তেমনি গ্রামেগঞ্জে চুরি-ডাকাতির অভিযোগও কমেছে। নাইট পেট্রোলিংয়ের কারণে আতঙ্কে রয়েছে মাদক কারবারীরাও।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, যেহেতু জেলার প্রত্যেকটা থানা এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে তল্লাশি চালায় পুলিশ, সে কারণে অপরাধীরা ধরা পড়ার আতঙ্কে থাকে।
পুলিশের টহল বাড়ার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চুরি-ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা কমেছে জানিয়ে চট্টগ্রাম পরিবহন মালিক সমিতির নেতা মো. ইব্রাহীম বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আমার বেশ কয়েকটি পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান আছে। প্রতিরাতেই পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান আটকিয়ে চাঁদাবাজি করত স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। চাঁদা না দিলে পণ্য নিয়ে যেত। গত এক মাসে মহাসড়কে এ ধরনের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে বলে জানান তিনি।
নাইট পেট্রোল শুরু হওয়ার পর সীতাকুণ্ড থানা এলাকায় ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান বলেন, নাইট পেট্রোলিংয়ে পুলিশ সুপার সশরীরে উপস্থিত থেকে পেট্রোলিংয়ের নেতৃত্ব দেন। গত এক মাসে নাইট পেট্রোলিংয়ে এসপি স্যার ৭ বার এসেছিলেন।
জানতে চাইলে লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে পুলিশের মনোবল বাড়াতে এসপি স্যারের এই উদ্যোগ টনিকের মতো কাজ করেছে। এসপি স্যার যখন সশরীরে মাঠে উপস্থিত থাকেন তখন যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা সাহস পাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, নাইট পেট্রোলিং শুরু হওয়ার পর গত একমাসে এসপি স্যার লোহাগড়াতে ৮ থেকে ৯ বার এসেছেন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন। তাদের অভিযোগ শুনে আমাদের সমাধানের নির্দেশনা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ বলেন, জেলাতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশ সুপারের। কোন কাজ করলে মানুষের কাছে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়বে, মানুষ উপকৃত হবে- সেটা নিতান্তই দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের এখতিয়ার।
জেলা পুলিশের উদ্যোগে প্রতিরাতে নাইট পেট্রোলিং চালানো অনেক কঠিন কাজ, যা চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার করছেন। আমি আশাবাদী তার এই উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলার অপরাধ কমবে এবং সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারি থেকে নাইট পেট্রোলিং শুরু হওয়ার পর ৩০-এর অধিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু। সব অভিযানেই তিনি বিভিন্ন পয়েন্টে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেছেন, তাদের অভিযোগ শুনে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :