ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইন অমান্য করে ফসলী জমি কাটার মহোৎসব চলছে জেলাজুড়ে। জমির উর্বর টপ সয়েল বা উপরিভাগ কেটে নষ্ট করা হচ্ছে জমি।এমনকি এসব জমি রাতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর ও অন্যান্য ফসলি জমি। যা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। স্থানীয় প্রশাসন নামমাত্র লোক দেখানো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমি কাটা হচ্ছে দিনের আলো কিংবা রাতের আঁধারে। ২৫-৩০ টি ট্রাক্টরে করে এসব মাটি পরিবহন করতে গিয়ে নষ্ট করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং এলজিইডির পিচঢালা রাস্তা। এছাড়াও সড়কের উপর পড়ে থাকা মাটি জমাট হয়ে বেকায়দায় ফেলছেন যানবাহন চালকদের। যা বৃষ্টির সিজনে রাস্তায় দেখা মিলবে কাদা ও রাস্তার পিচ উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা । ফলে যানবাহন চলাচলে ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হরহামেশায় ঘটে সড়ক দূর্ঘটনা। ধুলাবালির জ্বালায় অতিষ্ঠ সড়কের পাশে থাকা বাসিন্দা ও দোকানদাররা। তাদের দাবি, দ্রুত বন্ধ করা হোক এমন অবৈধ কর্মকান্ড।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের উজানিশার আহরন্দ ও বরিশলসহ নাটাই উত্তর–দক্ষিণ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বানিজ্যিক ভাবে মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বিজয়নগর উপজেলার বালিয়াজুরি নদী বাঁধ দিয়ে ফসলি জমি কেটে আমতলী (কাচা বাজার)এর পিছনে বড় একটি পুকুর ভরাট চলছে। বুধন্তি,হরষপুর, পাহাড়পুর,খাটিংগা সহ বেশ কয়েকটি স্থানে ও আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর সামনে ব্রিজের পানি চলাচল বন্ধ করে পুকুর ভরাট ও মোগড়া ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন ও আখাউড়া–কসবা রোডের পাশেই পুকুর ভরাট চলমান রয়েছে কোড্ডা ব্রিজ সংলগ্ন তিতাসের বিলে দেখা মিলে রাত ১০ টার পর মাটি কাটার উৎসব। পৌর শহরের তারাগন ও দক্ষিণ ইউনিয়নের নুরপুর সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ফসলি জমি কাটা ও ভরাট সহ বিক্রি হলেও স্থানীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকায়।
সরাইল উপজেলার কালিগচ্ছ ধরন্তী, চুন্টা,পাকশিমুল, পরমান্দপুর, নোয়াগাও কোড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে বানিজ্যিক ভাবে ফসিল জমির মাটি যাচ্ছে আশে পাশের জেলায় রাতের আঁধারে। নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউক ইউনিয়নের শান্তি নগর,হরিপুর ইউনিয়নের গোয়ালনগরসহ হাওয়রের বিভিন্ন স্থানে চলছে ফসলি ভরাট ও মাটি কাটা। কসবা উপজেলার ৩ ইউনিয়ন বিনাউটি,বায়েক,গোপিনাতপুর ও আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর শরিফপুর, তাড়ুয়া এই তিন ইউনিয়নের মাটি যাচ্ছে উপজেলার শহরের জলাধার জমি ও পুকুর ভরাটে ও আশেপাশের জেলায় ও ইটভাটায়। নবীনগর পশ্চিমপাড়া পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডে আ.লীগ নেতা ও বিএনপি নেতারা মিলমিশে ফসলের জমি কেটে চতুর্দিকে বেস্টনী দিয়ে বালু ভরাট করছে। প্রশাসনকে অবগত করলেও এর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাঞ্চারামপুর উপজেলার সোনারামপুর ও মানিকপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ফসলি জমি থেকে প্রশাসনকে মেনেজ ও রাতের আঁধারে মাটি কাটছে বানিজ্যিকভাবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এলাকায় ফসলী জমির টপ সয়েল বা মাটি কাটছে মাটিখেকোরা। সন্ধ্যা নামলেই এসব মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় থাকা বিশাল পুকুর ভরাট করতে ও ইটভাটায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীরা জানান, প্রকাশ্যে এসব ফসলি জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল। ফসলি জমির মাটি কেটে ভরাট করছে পুকুর, ডোবা-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়। এভাবেই তিন ফসলি জমির বুক চিরে ছুটে চলছে মাটি ভরাট করা ট্রাক্টর। জেলার বিভিন্ন স্থানে ফসলী জমিতে এখন চলছে মাটিকাটার মহাৎসব। দুই ফসলি কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে পতিত ভূমিতে। এতে দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে, বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত।
১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পুণরায় কাজটি করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আর ১০ বছরের কারাদন্ডের আইন থাকলেও তা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে না কেন প্রশ্ন রেখেছেন সাধারণ মানুষজন ।
ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ড করা পুকুরগুলো জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিবেশ আইন-১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর বিধান অনুসারে যেকোন জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ এবং ব্যক্তিগত পুকুর হলেও তা জলাধারের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা ভরাট করা যাবে না বলেও আইন রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সুশান্ত সাহা জানান, অতি লোভে পড়ে আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন একশ্রেণির জমির মালিক। খনিজ ও জৈব উপাদান বিশেষ করে হিউমাস (জৈব কণা) সমৃদ্ধ মাটির ওই অংশ তুলে ফেলার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। এর ফলে ৭/৮ বছর ওইসব জমিতে ফসলের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক রাকিবুল হাসান জানান, পুকুর ভরাট সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রূপালী বাংলাদেশকে জানান,কোন কোন জায়গায় অবৈধ ভাবে মাটি কাটা হচ্ছে লোকেশন জানান আমরা ব্যবস্থা নিবো। বিভিন্ন স্থানে আমাদের অভিযান চলছে ও ভবিষ্যতেও চলবে।
আপনার মতামত লিখুন :