৫ আগস্টের পর রাতারাতি সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসা সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সিলেটে চরম বেকায়দায় পড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মিজানুর রহমান রিয়াদকে ছাত্রাবাসে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে সিলেটসহ সারা দেশে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে সংগঠনটি। আত্মরক্ষার সব চেষ্টা করলেও ফেঁসে যেতে পারেন হামলায় অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা। ভিন্নমত প্রকাশে বাধা দেওয়ার জন্য অনেকেই এ ঘটনাকে সমালোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছেন।
জুলাই বিপ্লবের পর দলটির প্রতি যে সিম্প্যাথি তৈরি হয়েছে গত বুধবারের ঘটনা তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আহতদের স্ট্যাটমেন্টে শিবির নেতাকর্মীদের নাম উঠে এসেছে। এমনকি হামলাকারীদের নাম-পরিচয় ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে এ অবস্থায় সিলেটে সংগঠনের ইমেজ ফেরাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন্দ্র ও স্থানীয় নেতারা। তারা ঘটনায় দলের সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। ইসলামী ছাত্রশিবির সিলেট মহানগরের নেতারা হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখেও এসেছেন।
তারা বলেছেন, এ ঘটনায় ছাত্রশিবির জড়িত নয়। রাজনৈতিক ফায়দা নিতে দলটির ওপর হামলার দায় চাপানোর অভিযোগ করেন তারা। এই দাবির পক্ষে শিবির সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তবে এতসবের পরেও ধীরে ধীরে দায় এড়ানো কঠিন হয়ে উঠছে দলটির জন্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আহতদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে হামলার জন্য ছাত্রশিবিরের দিকেই ইঙ্গিত করছে। এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলনের নামে বৃহস্পতিবার রাতে যে মিছিল করা হয়েছে, সেটি তাদের কর্মসূচি নয় বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট জেলার মুখপাত্র মালেকা খাতুন সারা।
সারা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এটি অস্বীকার করেন। এই বিক্ষোভ মিছিলে হেলমেট পরা অবস্থায় কয়েকজনকে দেখা যায়। তারা সবাই মশাল জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন এবং মিছিলে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার নাম উল্লেখ করে দলটির বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ও কটূক্তিমূলক স্লোগান দেওয়া হয়। মিছিলে ছাত্রশিবিরের কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে। ওইদিন রাত ৯টার দিকে ঘটনার প্রতিবাদে সিলেট নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রদল।
গত বুধবার মধ্যরাতে সিলেটের এমসি কলেজে অতর্কিত হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান রিয়াদ গুরুতর আহত হন। এ হামলার জন্য রিয়াদ নিজেই দায়ী করেন ছাত্রশিবিরকে। হামলায় অংশ নেওয়া ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের নামও উল্লেখ করেন তিনি।
রিয়াদ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ১ম ব্লকের ১০১ নম্বর কক্ষের বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি কলেজ ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জওহর লুকমান মুন্নার নেতৃত্বে ১০-১২ জন শিবির কর্মী হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরাও একই তথ্য দেন। এরপরই ঘটনাটি সিলেটসহ সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
শনিবার দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে রিয়াদ বলেন, কলেজ ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জওহর লুকমান মুন্নার নেতৃত্বে শিবির কর্মী রুমে ঢুকে হামলা চালায়। এ সময় রড দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। হাত-পায়ের রগ কেটে ফেলার চেষ্টা করা হয়। রিয়াদ জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অন্যের একটি স্ট্যাটাসে কমেন্ট করার অপরাধে তাকে মারধর করে মারাত্মক জখম করা হয়।
রিয়াদ নিজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। জুলাই বিপ্লবে সিলেটের আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে। রিয়াদ জুলাই বিপ্লবের সক্রিয় কর্মী হলেও তিনি মূলত বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার এমসি কলেজ শাখার দায়িত্বশীল। আহত হওয়ার পরে সঙ্গত কারণেই তালামীয তাদের কর্মীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।
তারা বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট মহানগরীতে বিশাল এক বিক্ষোভ মিছিল শেষে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এ সময় তালামীযের সাবেক ও বর্তমান নেতারা ঘটনার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে অভিযুক্তদের বিচার চান।
এদিকে শহরে দিনের বেলা তালামীযের বিক্ষোভের পর কোনো ব্যানার ছাড়া রাত ১১টার দিকে হেলমেট পরে মশাল মিছিল করেন কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী। এরা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে। পরদিন শুক্রবার সিলেটের বিভিন্ন স্থানে তালামিয ও ছাত্রশিবির একে অন্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।
শুক্রবার মহানগর ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে নগরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। গত কয়েকদিন ধরে এমসি কলেজের ঘটনায় সিলেটে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এদিকে ঘটনার পর এর জন্য শিবিরকে দোষারোপ করায় মন্তব্য চাওয়া হলে বৃহস্পতিবার সারাদিন মিডিয়ায় মুখ খুলতে রাজি হননি এমসি কলেজ ছাত্রশিবির বা সিলেটের কোনো নেতাই। তারা ‘যা বলার কেন্দ্র থেকে বলা হবে’- এমন মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে শুক্রবার সকালে ইসলামী ছাত্রশিবির কেন্দ্র থেকে একটি বিবৃতি দেয়।
যেখানে ওই ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। দেরিতে ছাত্রশিবির বিবৃতি দিলেও তাদের অভিভাবক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এ ঘটনায় এখনো কোনো বিবৃতি বা মন্তব্য দেয়নি। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এমনকি তালামিযে ইসলামিয়ার অভিভাবক সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহও কোনো বিবৃতি দেয়নি। তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রিয়াদকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে এর জন্য নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন।
এমসি কলেজের ঘটনা জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। তালামীয নেতাদের দাবি, একে জবাব দিতে গিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়ানোসহ নানা অপপ্রচারের আশ্রয় নিচ্ছেন শিবির সমর্থকরা। যা দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিচ্ছে।
এদিকে সিলেটের ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক দুটি বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্রদল। তারা শিক্ষার্থীর ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে।
এমসি কলেজ তালামীযের সভাপতি আহবাব হোসেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গুরুতর আহত রিয়াদের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রায় সময়ই বমি করছেন। সিটি স্ক্যানে মাথায় বড় ধরনের দুটি আঘাতের চিহ্ন ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বিষয়টি শঙ্কার।
ফলে পরিবারসহ আমরা কেউই তাকে নিয়ে স্বস্তিতে নেই। পাশাপাশি তার নিরাপত্তা নিয়েও আমরা শঙ্কিত। নজরদারি করছে শিবির কর্মীরা। নানাভাবে তারা তার ও তার পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি জানান, গতকাল শনিবার বিকেলে তাকে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য ওসমানী হাসপাতাল থেকে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ঘটনায় কলেজ প্রশাসন থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন কবির চৌধুরীকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে
আপনার মতামত লিখুন :