ধরাছোঁয়ার বাইরে রাঘববোয়াল পুলিশের কবজায় চুনোপুঁটি

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১০:৪৫ এএম

ধরাছোঁয়ার বাইরে রাঘববোয়াল পুলিশের কবজায় চুনোপুঁটি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সারা দেশে ঝিমিয়ে পড়েছিল, ঠিক তখন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সেই আন্দোলন জিইয়ে রেখেছিল চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতা। ছাত্র-জনতার অদম্য সেই প্রতিরোধ ভাঙতে হায়েনার মতো যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, অভ্যুত্থানের পর পুলিশের সক্রিয়তায় তাদের মধ্যে মাঠের কর্মীরা গ্রেপ্তার হলেও রাঘববোয়ালা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বাকিরা এখনো আত্মগোপনে।

নগর, জেলা পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশে দায়ের করা হয়েছে ৬১টি মামলা। এর মধ্যে সিএমপিতে দায়ের করা হয় ৫৫টি এবং চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হয়েছে ছয়টি মামলা। 

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে সিএমপিতে দায়ের করা ৫৫টি মামলায় এরই মধ্যে ৮৩৬ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে নগর পুলিশ। চলতি মাসের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৬০০। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার মামলায় এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব ৭। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জেলা পুলিশের কাছ থেকে গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

নগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সিএমপির ১৬টি থানার মধ্যে ৮ থানায় ৫৫টি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় ১৬টি, সদরঘাট থানায় ২টি, বাকলিয়া থানায় ৪টি, খুলশী থানায় ২টি, চান্দগাঁও থানায় ১০টি, পাঁচলাইশ থানায় ১২টি, ডবলমুরিং থানায় ৮টি এবং হালিশহর থানায় ১টি। 

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের আওতাধীন থানাগুলোতে আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলায় মামলা হয়েছে ৬টি।

বৈষম্যবিরোধী হামলায় করা মামলায় চলতি মাসের ২১ দিনে সিএমপিতে গ্রেপ্তার ৬০০ জন। এর মধ্যে ১ ফেব্রুয়ারি নগর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৫ জন, ২ ফেব্রুয়ারি ২৮ জন, ৩ ফেব্রুয়ারি ৪২ জন, ৪ ফেব্রুয়ারি ৪৬ জন, ৫ ফেব্রুয়ারি ৩৪ জন, ৬ ফেব্রুয়ারি ৪০ জন, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৬ জন, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০ জন, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯ জন, ১০ ফেব্রুয়ারি ৩০ জন, ১১ ফেব্রুয়ারি ২৮ জন, ১২ ফেব্রুয়ারি ৩০ জন, ১৩ ফেব্রুয়ারি ৪০ জন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯ জন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২৩ জন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ৪৯ জন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ৩২ জন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২৯ জন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২৫ জন, ২১ ফেব্রুয়ারি ২৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে নগর পুলিশ। 

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে গত বছর ২৭ অক্টোবর বিকেল ৩টার দিকে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর (গোয়েন্দা) পুলিশ।

১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে আটক করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। পরে চট্টগ্রামে দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে ফ্যাসিবাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ছাড়া গ্রেপ্তারের তালিকায় নেই আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের তেমন কোনো নেতা। 

আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, আবদুচ ছালাম, মুজিবর রহমান, মহিউদ্দিন বাচ্চু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। নগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগ নেতা বাবর আলী, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. এসরারুল হক, জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, চকবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনু, ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দীন, যুবলীগ নেতা আরশাদুল আলম বাচ্চু, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিসহ অনেকেই। 


ফ্যাসিবাদি আওয়ামী সরকারের যেসব নেতা এখনো আত্মগোপনে আছেন, তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না।  অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশের ধীরগতির অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা আবুল হাসেম বক্কর। 

তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশের সিনিয়র সিটিজেন কমিটির মিটিংয়ে একাধিকবার বলেছি, ফ্যাসিবাদ সরকারের যারা আত্মগোপনে আছেন, তাদের দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার করতে হবে। 

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান হাজারও ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক রিজাউর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদের যারা দোসর ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে দায়ের হওয়া ৫৫টি মামলায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম) রইস উদ্দিন বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে নগর পুলিশ।  
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!