ঢাকা মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বছরে শতকোটি টাকার জাটকা পাচার

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫, ০২:২৩ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বরিশালের তালতলী বাজারের আধিপত্য ধরে রাখতে আওয়ামী সন্ত্রাসী টুটুল বাহিনী ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও এই বাহিনী সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাজার থেকে মৎস্য সম্পদ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাচারের তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাহিনীর প্রধান নীরব হোসেন টুটুল ভারতে আশ্রয় নিলেও তার লালিত সন্ত্রাসী মোশারেফ সিকদার, মিরাজ সিকদার, কালু সিকদার, সাকিন সিকদার, সেলিম ও সবুজরা এখন উত্তর আমানগঞ্জ-শায়েস্তবাদ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আলোচিত টুটুল পলাতক থাকায় তার এই বাহিনীকে অর্থের বিনিময়ে শেল্টার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বরিশাল মহানগরের ওয়ার্ড পর্যায়ের দুই বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বরিশালের তালতলী বাজার থেকে প্রতি বছর শতকোটি টাকার জাটকাসহ মাছ পাচার করে আসছিল বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুলের বাহিনী।

সে সময় সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ সিটির মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় নাজিরের পোলের টুটুল আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

মূলত তার কাঁধে ভর করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রতি বছর শতকোটি টাকার জাটকা, রেণুপোনাসহ অবৈধ মাছ পাচার করে আসছেন সাকিন-কালু-মিরাজেরা।

পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, অবৈধভাবে মাছ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা চালানোর অভিযোগে বাহিনীপ্রধান টুটুলসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

তাদের মধ্যে টুটুল ভারতে এবং মিরাজ সিকদার দেশে আত্মগোপনে থাকলেও বাকিরা ভোল পাল্টে নিজেদের বিএনপির বড় নেতাকর্মী দাবি করছেন।

টুটুলের অবর্তমানে তারা অবৈধ ব্যবসার শেল্টারদাতা হিসেবে বরিশাল নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এমন দুজন বিএনপি নেতার সঙ্গে চুক্তিও করে নিয়েছেন।

মাস শেষে তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দেওয়াসহ আগের মতোই কাউনিয়া থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে অবৈধ মাছ তালতলী বাজার থেকে পাচারের ফন্দি আঁটছে। 

আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের মৎস্য সম্পদ পাচারের এই পূর্বপরিকল্পনা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরে মৎস্য অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে।

দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা রিপন কান্তি ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা জামাল হোসেন জানিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে এবার অবৈধ বাণিজ্য রুখে দেওয়া হবে।

যেমন কথা তেমন কাজ, যার প্রমাণ মেলে শনিবার গভীর রাতে। মাঠ কর্মকর্তা জামালের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের অবৈধ একটি মাছের চালান শনিবার রাতে আটকে দেওয়া হয়। তিনটি অটোরিকশাভর্তি জাটকা তালতলী বাজার থেকে জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময় মৎস্য বিভাগের মাঠ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিমল চন্দ্র দাস।

তার বিরুদ্ধে টুটুল বাহিনীর কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণসহ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সবশেষ বিতর্কিত ওই কর্মকর্তাকে নওগাঁ জেলায় শাস্তিমূলক বদলি করেছে সরকার।

মৎস্য অফিস সূত্র জানিয়েছে, সদর উপজেলার তালতলীতে একটি পাচারকারী সিন্ডিকেট রয়েছে, বিমল বাবুর বদলির পরে তারা ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতার সুপারিশ নিয়ে চুক্তি করেছে।

কিন্তু জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি এবং সদর উপজেলা কর্মকর্তা জামাল হোসেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মৎস্য সম্পদ ধ্বংসকারীদের সঙ্গে কোনো আপস নয়, বরং তাদের ঠিকানা হবে জেল! 

তালতলীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সিটির ওয়ার্ড বিএনপির দুই নেতার সদর উপজেলার অবৈধ বাণিজ্যে শেল্টার দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেনি স্থানীয় বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

তাদের অভিযোগ, টুটুল বাহিনী গত ১৫ বছরে তালতলী বাজার থেকে শতকোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে এবং সেই টাকা দিয়ে সাকিন, কালু, সবুজরা বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি।

টুটুলের খাস লোক সাকিন একটি ট্রাকও কিনেছেন; মূলত সেই ট্রাক ব্যবহার করেই রাতে জাটকা পাচার হয়।

ইউনিয়ন বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের শাসনামলে কাউনিয়া থানা পুলিশসহ টুটুলকে মাসিক মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মাছ পাচার করেন মোশারেফ, সাকিন, কালু ও নিজাম-সবুজরা।

টুটুল পালিয়ে ভারতে গেলে তার সাগরেদ মিরাজ সিকদারও মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তবে মামলার আসামি হয়েও বিএনপি নেতাদের শেল্টারে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজাম সিকদারসহ বাহিনীর একাধিক সন্ত্রাসী।

আগামীতে তাদের কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা অবৈধভাবে মাছ পাচার করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয়রা। 

তালতলী বাজারের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা শুধু মৎস্য সম্পদ ধ্বংসই করছে না, পাচারের মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে।

বিশেষ করে অভিযোগ রয়েছে কাউনিয়া থানা পুলিশের সাবেক ওসি মো. আসাদুজ্জামান ও মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে।

সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ দুই পুলিশ কর্মকর্তা কাউনিয়া থানায় দায়িত্ব পালনকালে অন্তত ২ কোটি টাকার বেশি নিয়ে গেছেন।

অভিযোগ আছে, ওসি আসাদুজ্জামান পুলিশের একটি টিম তালতলী বাজারে পাঠিয়ে দিলে তাদের উপস্থিতিতেই জাটকা ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, যা নিয়ে সে সময় সংবাদপত্রে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছিল।

কিন্তু খোদ পুলিশই যখন ব্যবসায় জড়িত, তখন ব্যবস্থা আর নেয় কে এমন প্রশ্নে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গন তখন সরগরম হয়ে উঠেছিল। 

জানা গেছে, টুটুল বাহিনীর এই অবৈধ বাণিজ্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত বছর তরিকুল ইসলাম নামের এক সংবাদকর্মীকে কুপিয়ে জখম করেন সন্ত্রাসী মিরাজ, সবুজ ও সাকিনেরা।

ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগের আমলে একটি মামলাও হয়েছিল।

সূত্রের খবর হচ্ছে, সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর টুটুল তার বাহিনীর সদস্যদের রক্ষায় তৎসময়ে আপসের প্রস্তাব দেওয়াসহ থানা-পুলিশকে মামলা নিতে বারণও করেছিলেন।

কিন্তু সেই সন্ত্রাসের খবর স্থানীয় সংবাদমাধ্যমসহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ পেলে চাপে পড়ে যায় থানা-পুলিশ।

পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মামলা গ্রহণেও বাধ্য হয়।

৫ আগস্ট আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটলে বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। তখন তারা কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল।

তবে ফাল্গুন মাস শুরু হতেই তারা এখন বিএনপি নেতাদের শেল্টার নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছে, যা দেখে ইউনিয়ন বিএনপি নেতাকর্মীরাও হতবাক। 

অবশ্য কাউনিয়া থানা পুলিশের ওসি নাজমুল নিশাতও তালতলী থেকে অবৈধভাবে মাছ পাচার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, অতীতের ন্যায় অবৈধ বাণিজ্য কিংবা অপরাধকে কাউনিয়া থানার পুলিশ আর প্রশ্রয় দেবে না।

এক্ষেত্রে জনস্বার্থে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত এমন ব্যক্তি যদি মাছ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়, তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সেক্ষেত্রে অপরাধারীর পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তা দেখার সুযোগ থাকবে না।

আওয়ামী লীগের দোসরদের নিয়ে বরিশালের তালতলীতে দুই বিএনপি নেতার অবৈধ বাণিজ্যের খবর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিজরুজ্জামান ফারুকও অবগত হয়েছেন।

তিনি জানান, টুটুল বাহিনীর লোকদের সাথে দুই কর্মীর একজোট হওয়ার বিষয়টি আগেই জানতে পেরেছেন এবং তিনি তাদের ডেকে নিয়ে সাবধান করে দিয়েছেন।

এর পরেও যদি তারা অনৈতিক কাজে জড়িত থাকেন, সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং তাদের অবৈধ মাছ পুলিশ-প্রশাসনকে ধরতে আহ্বান রাখেন শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা।