উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি শাহজাদপুর বাঘাবাড়ী নৌবন্দর। কিন্তু সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের অভাবে প্রায় অচলাবস্থা। ফলে এ জনপদের কৃষি অর্থনীতিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বাঘাবাড়ি নৌবন্দর থেকে উত্তরের ১৬ জেলায় রাসায়নিক সার, জ্বালানি তেল, কয়লা, চাল, গম, সিমেন্টসহ নানা পণ্য সরবরাহ করা হয়। চিরচেনা সেই ব্যস্ততা এখন অতীত। এখনও উন্নীত করা হয়নি ১ম শ্রেণিতে এছাড়া পর্যাপ্ত সুবিধার অভাবসহ নানা কারণে ক্রমেই প্রাণস্পন্দন হারাচ্ছে বন্দরটি। বেকার হয়ে পড়ছে শত শত শ্রমিক।
আশির দশকে নির্মিত এ বন্দরের বাঘাবাড়ী-আরিচা নৌরূটে ২য় শ্রেণির পণ্যবাহী ৭ ফুট ড্রাউটের কার্গো জাহাজ চলাচলের নিয়ম থাকলেও সেখানে নৌপরিবহন ব্যবসায়ী ও কার্গো জাহাজ মালিকরা শুষ্ক মৌসুমে বেশি লাভের আশায় কার্গো জাহাজে ১৪/১৫ ফুট ড্রাউট পর্যন্ত পণ্য বোঝাই করে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের অভিমুখে রওয়ানা দেয়। কিন্তু ওভারলোড কার্গো জাহাজ পথিমধ্যে আটকা পড়ে। ফলে বিভিন্ন স্থানে জাহাজ থেকে মালামাল কমিয়ে ৭/৮ ফুট ড্রাউট লাইটার্স করে বন্দরে ভেড়ানো হচ্ছে। ফলে দিনে দিনে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরটি কার্যত প্রাণচাঞ্চল্য হারাচ্ছে।
জানা গেছে, এখন চট্টগ্রাম থেকে আসা পণ্যবাহী কার্গো জাহাজগুলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরের নওয়াপাড়া বন্দরে পণ্য খালাস করছে। সেখান থেকে সড়কপথে উত্তরাঞ্চলে কৃষি উপকরণ পরিবহন করা হচ্ছে। বন্দরে সার পরিবহন প্রায় বন্ধ থাকায় বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) গুদামে এখন সার আনা হচ্ছে নওয়াপাড়া বন্দর থেকে। তবে সেগুলো সময়মতো পৌঁছায় না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া স্বাভাবিক সময়ে তেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলো অন্তত ১০-১২ লাখ লিটার তেল পরিবহন করলেও শুষ্ক মৌসুমে নদীপথে ঝুঁকি থাকায় সেখানে ৮ থেকে ৯ লাখ লিটার তেল পরিবহন করছে।
বাঘাবাড়ী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন ও খাদ্য পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বিভিন্ন এলএসডি গোডাউন থেকে সরকারি চাল কার্গো জাহাজযোগে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে ভিড়িয়ে জাহাজ থেকে আনলোড করার পর বাঘাবাড়ী এলএসডি গোডাউনে লোড করা হয়। পরে কার্গো জাহাজে সরকারি ওইসব চাল বরিশালসহ দক্ষিণবঙ্গের নানা স্থানে সরবরাহ করা হয়। অপরদিকে, খুলনার মংলা বন্দর থেকে কার্গো জাহাজ যোগে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে গম আসার পর তা বাঘাবাড়ী এলএসডি গোডাউনে সংরক্ষণের পর তা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। এ বন্দর থেকে বছরে ১ থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল, গম লোড-আনলোড হয়ে থাকে। তবে এবার সেই মাত্রা কিছুটা কম বলেই মনে হচ্ছে।
কার্গো জাহাজের চালকেরা জানান, অধিকাংশ পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও নাব্যতা সংকটের জন্য বাঘাবাড়ীতে ফুল লোড জাহাজগুলো মাল খালাস করতে পারছে না। আরিচায় খালাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বাঘাবাড়ী রুটে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৪/১৫ ফুট ড্রাফটের ভারী পণ্যবাহী জাহাজ চালানো যায় না বলে অধিকাংশ শিপিং কোম্পানি এখন এ রুটে চলাচল বন্ধ করে নওয়াপাড়া বন্দরমুখী হয়েছে।
নৌবন্দরে কর্মরত শ্রমিক উপজেলার আহম্মদপুর গ্রামের আনসার আলী (৪৫), হানিফ আলী মোল্লা বলেন, ২ বছর আগেও এ সময়ে বন্দরে ১২-১৩ শতাংশ শ্রমিক কাজ করতো। আরিচার দাসকান্দীতে পণ্যদ্রব্য আনলোড করায় বাঘাবাড়ী বন্দরে কাজ কমে গেছে। অতীতে ৫০-৬০টি সার বোঝাই জাহাজের জটলা এ সময়ে লেগেই থাকতো। কিন্তু দু’তিন বছর ধরে জাহাজ কম আসায় প্রায় ৫-৬ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। নৌ-চ্যানেলে সবসময় যদি ১৫-২০ ফুট ড্রাফটের পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা যেত, তাহলে হয়তো বন্দরটি প্রাণ ফিরে পেতো।
বাঘাবাড়ী বন্দর নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাঘাবাড়ী নদীবন্দর প্রতিষ্ঠার সময় নৌযানের আকার ছোট ছিল এবং পণ্য পরিবহনের সক্ষমতাও অপেক্ষাকৃত কম ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নৌযানের আকার ও ধারণক্ষমতা বাড়লেও বন্দরের আধুনিকীকরণ হয়নি। ২য় শ্রেণির নৌরুটে ১ম শ্রেণির জাহাজ প্রবেশ করালে তো সমস্যা হবেই। বন্দরটিকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করতে একটি মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে জমা দেয়া হয়েছে।