গাছে গাছে ঝুলছে পাকা টমেটো। টমেটোর ভারে নুয়ে পড়েছে গাছ। কিন্তু সেই টমেটো তুলতে আগ্রহ হারিয়েছেন চাষিরা। যার কারণে ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে টমেটো।
আবার ক্ষেত থেকে তোলার পর কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় বিক্রি না করে তা ফেলে দিচ্ছেন কৃষকরা। লাল টকটকে এসব পাকা টমেটো ভাসিয়ে দিচ্ছেন খালের পানিতে। ফেলে রাখছেন রাস্তার পাশে ও ক্ষেতে।
এমনই চিত্রের দেখা মিলল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। যার কারণে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন শতশত কৃষক।
উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, এ বছর কোটালীপাড়া উপজেলায় ৪৩২ হেক্টর জমিতে এই টমেটো আবাদ করা হয় এবং বাম্পার ফলন হয়।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, টমেটোর সিজনের শুরুতে ভালো দাম পাওয়া গেলেও এখন দরপতনের কারণে তারা টমেটো তুলতে আগ্রহ হারিয়েছেন। এক মণ টমেটো বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে বাজারজাতকরণে। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
সরেজমিনে রবিবার (২ মার্চ) সকালে উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের চকপুকুরিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দিগন্ত জুড়ে সবুজের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধু টমেটো বাগান। মাঝে মাঝে জলরাশি। প্রকৃতি যেন সেজেছে আর আপন খেয়ালে।
বিস্তীর্ণ এলাকার এমন দৃশ্য চোখে পড়রে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়ন জুড়ে।
মূলত কোটালীপাড়া এলাকাটি নিম্নাঞ্চল হওয়ায় এখানের জমিগুলো এক ফসলি। যে কারনে এসব জমিতে ঘের কেটে মাছ চাষ ও ঘের পাড়ে বারো মাসই সবজি চাষাবাদ করা হয়।শীতকালে টমেটোর আবাদ করা হয়। এ বছর বাহুবলী, বিউটি প্লাস, উদয়ন জাতের টমেটোর ফলন বেশি হয়েছে।জমিতে ফলন ভালো হলেও দাম না পেয়ে হতাশায় কৃষকরা।
চকপুকুরিয়া গ্রামের কৃষক মানিক বসু বলেন, আমি প্রায় একশত পঞ্চাশ শতক জমিতে টমেটো চাষ করেছি। ধার করে এই চাষ করতে প্রায় আড়াই থেতে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ক্ষেতের মধ্যে ফলনও হয়েছে ভালো। কিন্তু টমেটো বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছি তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে বাজারজাতকরণে। প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি করতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই টাকা দরে।
নলুয়া গ্রামের টমেটো চাষি সুব্রত রায় বলেন, ৩ টি ঘেরের পাড়ে টমেটোর চাষ করেছি। তাতে প্রায় খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। টমেটো বিক্রি করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মত বিক্রি করেছি।
এবার লাভ তো দূরের কথা সারা সিজন যে পরিশ্রম করলাম তা বৃথা গেল। এর থেকে অন্যের জমিতে কাজ করলেও সংসারে দুটো টাকা আসতো। তিন মণ টমেটো বাজারে নিয়ে গেলে বিক্রি হয় ২ শত ৪০ টাকা থেকে ৩ শত টাকা। আর বাজারজাতকরণে খরচ হয় আরও বেশি।
মাদারীরপুর থেকে এখানে টমেটো ক্রয় করতে আসা ব্যবসায়ী সালাম শিকদার বলেন, প্রতি বছরই আমরা কয়েকেজন ব্যবসায়ী এখান থেকে টমেটো কিনে মাদারীপুরে বিক্রি করি। বর্তমানে বাজারে টমেটোর দর ভালো না। তাই আমরাও প্রতি কেজি টমেটো ২/৩ টাকার বেশি দিতে পারি না। এতে কৃষক ও আমরা উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।
চকপুকুরিয়া টমেটো আড়ৎ মালিক শংকর হাজরা বলেন, আমার আড়তে ১৪ থেকে ১৫ জন লেবার কাজ করে টমেটোর সিজনে। অন্যান্য বছর এখান থেকে টমেটো কিনে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় টমেটো পাইকারি বিক্রি করে ভালো টাকা পেতাম। এবার সারাদেশে টমেটোর দাম কমে যাওয়ায় এখন আমার কর্মচারীদের বেতন দেওয়াই মুশকি হয়ে দাড়িয়েছে।
কলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট বিজন হালদার বলেন, ঘেরপাড়ে টমেটো চাষ লাভজনক হওয়ায় শত শত কৃষক প্রতিবছর টমেটো চাষ করে ভালো টাকা লাভ করেন। কিন্তু এবার ভালো দাম না পাওয়ায় উৎপাদন খরচও উঠছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। দাম খুব কম হওয়ায় ক্ষেত থেকে অনেকে টমেটো তুলছেন না কৃষকরা। এ জন্য ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে বহু কষ্ট ও অর্থব্যয়ে আবাদ করা এই টমেটো।
কোটালীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দোলন চন্দ্র রায় বলেন, এ বছর কোটালীপাড়ায় টমেটোর ব্যাপক ফলন হয়েছে। শুরুতে টমেটো চাষীরা লাভের মুখ দেখলেও বর্তমানে বাজারে ভালো দাম না পাওয়ায় কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের ফসল চাষে আরও আগ্রহী হতেন চাষিরা।
তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলে যদি টমেটো প্রক্রিয়াকরণের কোনো ব্যবস্থা থাকত বা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার থাকত, তাহলে এসব টমেটো নষ্ট হতো না। তাছাড়া দেশের বড় বড় সস ও চিপস কোম্পানীগুলো সরাসরি এই এলাকার ক্ষেত থেকে টমেটো ক্রয় করতো তাহলে কৃষকেরা ভালো দাম পেত ও লোকসানের হাত থেকে বাঁচত।
আপনার মতামত লিখুন :