চট্টগ্রামের সাতকনিয়ায় তারাবির নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে লোকজন জড়ো করে গণপিটুনিতে নিহত নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ ছালেক (৩৫) জামায়াতের সক্রিয় কর্মী। এ সময় গুলিতে আহত হয়েছেন অন্তত আরও পাঁচজন। তারা চট্টগ্রাম মহানগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সোমবার (৩ মার্চ) রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের চূড়ামণি গ্রামের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতার মাছের খামার ও ইটভাটা লুটের ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
পুলিশ বলছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে ঠিকই। তবে নিহত যুবকরা রাতে কেন ওই এলাকায় গিয়েছিলেন এবং তাদের পিটুনি দিয়ে কেন হত্যা করা হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। পুরো বিষয়টি জানার জন্য তদন্ত চলছে।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিকেলে সাতকানিয়া থানার ওসি মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার নেপথ্যে কাহিনী বের করার চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হওয়া একটি বিদেশি পিস্তল, আটটি গুলির খোসা ও একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঘিরে রহস্য দানা বাঁধছে।
তবে সম্প্রতি সাবেক এওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নজরুল ইসলামের মাছের খামার এবং ইটভাটায় লুটের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে নেজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। নজরুলের স্ত্রী জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ ঘটনার জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না, তাও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
নিহত ব্যক্তিদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোমবার রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে নিহত মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে এবং মোহাম্মদ ছালেক গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে।
আর গুলিবিদ্ধ ৫ ব্যক্তিকেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন- ফরিদ উদ্দিন (৩৬), ওবায়দুল হক (২২), নাসির উদ্দিন (৩৮), আব্বাস উদ্দিন (৩৮) এবং মো. মামুনুর রশিদ (৪৫)। পরে স্বজনরা তাদের চট্টগ্রাম পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন বলে জানা গেছে।
ঘটনার খবর পেয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতুসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসপি সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি পুরোপুরি এখনও ক্লিয়ার হতে পারিনি। কী কারণে এ ঘটনা ঘটল, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’
ঘটনার বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকেও দু’ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। একপক্ষ জানিয়েছে, একদল ডাকাতকে স্থানীয় জনতা ঘিরে ফেললে তারা পালানোর সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। এরপর জনতা দু`জনকে ধরে গণপিটুনি দিলে তারা ঘটনাস্থলে মারা যান।
আরেকপক্ষের দাবি, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সাতকানিয়ায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দু’পক্ষের মধ্যে প্রথমে গোলাগুলি হয়। পরে স্থানীয় জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে দু’জনকে ধরে পিটুনি দিয়ে হত্যা করে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেজাম উদ্দিন এলাকায় আসতেন না। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিনি এলাকায় ফেরেন। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নেজামসহ একদল যুবক ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় যান। সেখানে তাদের দেখে মসজিদের মাইকে এলাকায় ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঘোষণা শুনে এলাকাবাসী তাদের আটকের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। এ সময় এলাকাবাসীকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পিটুনিতে নিহত হন নেজাম ও ছালেক। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন স্থানীয় চার বাসিন্দা ও এক দোকানি।
এদিকে নিহতদের জামায়াতের সক্রিয় কর্মী দাবি করেছেন দলটির স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী। তারা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। এলাকায় বিরোধ মীমাংসার জন্য একটি সালিস বৈঠকের কথা বলে নেজাম ও তার সঙ্গীদের এওচিয়ায় ডেকে নিয়ে মাইকে ডাকাত পড়েছে ঘোষণা করা হয়। এরপর নেজাম ও তার সঙ্গীদের পিটুনি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দু’জনের মাথায় পর্যায়ক্রমে আঘাত করে হত্যা করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোসেন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসেন নেজাম। তখন থেকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় আরেকটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে নেজামের। দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত দুবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিপক্ষের লোকজন নেজাম উদ্দিন ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর ইউনিয়ন শাখার সেক্রেটারি নিহত দু’জনকে জামায়াতের সক্রিয় কর্মী দাবি করলেও উপজেলা আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন বলেন, নিহত ব্যক্তিরা জামায়াতের তালিকাভুক্ত কোনো কর্মী নন। হয়তো জামায়াতকে ভালোবাসেন। এ ঘটনা কি পরিকল্পিত, নাকি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে, তা বের করার দায়িত্ব প্রশাসনের।
আপনার মতামত লিখুন :