ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেণী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক বাহিনীর প্রধান বলে পরিচিত হানিফ, তার শ্যালক ও বিশিষ্ট সহযোগী লিটন হোসেন এবং আরেক সহযোগী রাইসুল ইসলাম রাজু খুন হন।
তারা নিহত হওয়ার ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায় উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। নিহত হানিফ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগরের বাসিন্দা। লিটন হোসেন তার অন্যতম সহযোগী এবং আপন শ্যালক।
তিনি শৈলকুপা উপজেলার শ্রীরামপুরের বসিন্দা, অপর সহযোগী রাইসুল ইসলাম রাজু কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুরের বাসিন্দা। তারা তিনজনই অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীদের গুলিতে এবং ধারালো অস্ত্রের কোপে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে সন্দেহভাজনকে আটক করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গত ৪ মার্চ র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে তারা তোফাজ্জেল হোসেন নামে একজনকে আটক করেছেন। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি র্যাব ঝিনাইদহ শহরের সার্কিট হাউস এলাকা থেকে আবু সাইদ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সোনাতলা থেকে আনারুল ইসলাম রাজ এবং গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া থেকে মামুন নামে আরেকজনকে আটক করে। এ নিয়ে মোট আটক চারজন।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে সংবাদকর্মীদের কাছে পাঠানো মেসেজে এই তিন হত্যাকাণ্ডের দায় তারা স্বীকার করেন। পরদিন নিহতের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম ইশা বাদী হয়ে ১৫-১৬ জন অজানা ব্যক্তির নামে শৈলকুপা থানায় মামলা করেন।
এলাকার সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, নিহত হানিফ ও তার ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম ইশা হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবীদের পক্ষে নারায়ণকান্দি বা কায়েতপাড়া বাঁওড় বাৎসরিক ইজারা নিয়ে গত পাঁচ-ছয় বছর মাছ চাষ করে আসছিলেন। এই বাঁওড়ে যেহেতু কয়েক কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হচ্ছিল, এলাকায় আধিপত্য ও বাঁওড় দখল নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক গ্রুপের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
থানায় মামলা হয়েছে, নতুন করে কোনো সহিংসতাও ঘটেনি, কিন্তু শান্তি বিদায় নিয়েছে শুধু ওই এলাকায় নয়, পুরো উপজেলার মানুষের মন থেকে। তারা ভাবছে, আবার বুঝি ফিরে এলো পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা ও জাসদ গণবাহিনীর মতো আত্মগোপনে থাকা সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যরা।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায় স্বীকার করে মোবাইল ফোনে জাসদ গণবাহিনীর পক্ষ থেকে বিবৃতিমূলক বার্তা নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন আর সমালোচনা। একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচজনকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়।
নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক কমান্ডার এবং শতাধিক হত্যা মামলার পলাতক আসামি হানিফসহ এই তিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই রাতেই ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চারজনকে আটক করলেও তাদের কাছে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ বলে বিবেচিত ওই তিনজনের বিষয়ে নির্দিষ্ট এবং সর্বশেষ তেমন কোনো তথ্য নেই। ফলে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী সন্ত্রাসী এবং এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ক্লু তারা উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তবে র্যাব মনে করছে, পুলিশ শিগ্্গিরই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে।
এই মুহূর্তে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হলেও হরিণাকুণ্ডুর ভবানীপুর, তাহেরহুদা ও পোলতাডাঙ্গা গ্রামের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা জানান, একই সঙ্গে তিনটি খুনের ঘটনায় তারা আবার কয়েক বছর আগের ঘটনার দিকে ফিরে যাচ্ছেন, যেখানে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, দখলাদারি, চাঁদা আদায় আর নারী নির্যাতনের মতো হীন কর্মকাণ্ড অবারিত ছিল, মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বলে তেমন কিছুই ছিল না।
এ ব্যাপারে শৈলকুপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাসুম খানের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানালেন, তারা এই মুহূর্তে এই তিন খুনের ক্লু বা মোটিভ জানতে না পারলেও এটা বুঝতে পারছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কতিপয় সন্ত্রাসী বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কায়েতপাড়া বাঁওড় এবং স্থানীয় এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের শত্রুতা ধরেই এই তিন হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তবে শিগগিরই এর কারণ উদ্ধার এবং জড়িতদের আটক করতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেন ওসি মাসুম খান।