ঢাকা সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫

স্বস্তিতে ডেথ জোন টিলাগড়

সিলেট ব্যুরো
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৫, ১০:৫৬ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গে ঝলসে গেছে ‘দুঃস্বপ্নের টিলাগড়’। দীর্ঘ দুই যুগ পর সিলেটের ডেথ জোন হিসেবে পরিচিত সেই টিলাগড়ে নেমে এসেছে স্বস্তি।

যে টিলাগড়কে সিলেটবাসী চেনেন আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায়, নিভে গেছে সেখানকার অগ্নিগর্ভের শিখাগুলো। যারা সব সময় টিলাগড়কে গরম করে রাখতেন, উত্তপ্ত করে রাখতেন রাজনীতির মাঠে ও ময়দানে, তারা এখন ফেরারি। এই সুযোগে যেন হাফ ছেড়ে রক্ষা পেয়েছে আতঙ্কের জনপদ টিলাগড়। এখন আর কেউ বলছে না, ‘সাবধান, সামনে টিলাগড়’। সিলেট শহরের উৎকণ্ঠার এই জনপদ এখন অনেকটা শান্ত। অনেকটাই নীরব। 

অবশ্য এই ‘অনেকটা’ হতে পারত ‘পুরোটাই’! সেই অশান্ত জনপদ টিলাগড় থেকে যখন ৫ আগস্টের দমকা হাওয়ায় আতঙ্কের ধুলোবালু উড়ে গেছে, তখনই শূন্য জায়গায় এসে বসার চেষ্টা করছে নতুনরা। 

টিলাগড় আলোচনার কেন্দ্রে থাকার কারণ এমসি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোকে ঘিরে সিলেটের টিলাগড়ে ছাত্রলীগের গ্রুপিং ও হত্যার রাজনীতি শুরু হয় ২০০৩ সালে। প্রথম দিকে এমসি কলেজ ও সিলেট সরকারি কলেজকে কেন্দ্র করে টিলাগড়ে ছাত্রলীগের শক্তিশালী গ্রুপ গড়ে ওঠে। এরপর থেকে কলেজ ক্যাম্পাস ও হোস্টেলের দখল, সেখানে সংঘটিত হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন ছিল আলোচনায়। জুলাই বিপ্লব তাদের সরিয়ে দিয়েছে সেই জায়গা থেকে। আলোচনায় এখন তারা নেই। আলোচনায় নাম লিখিয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবির। সম্প্রতি এমসি কলেজ হোস্টেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, শিক্ষার্থী রিয়াদকে মারাত্মক জখম করে হাসপাতালে পাঠিয়ে আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে তারা।

ফলে সিলেট শহরের উৎকণ্ঠার এই জনপদ এখনো পুরোটা শান্ত ও নীরব হতে পারছে না! এজন্য এখনো টিলাগড় পুরোপুরি আতঙ্কমুক্ত হতে পারেনি। গেল দুই যুগেরও কম সময়ে এখানে আটটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

সেই টিলাগড়কে মূলত নেতৃত্ব দিতেন দুজন রঞ্জিত সরকার ও আজাদুর রহমান আজাদ। এ দুজনের নামেই উঠত-বসত টিলাগড়। তারা আওয়ামী লীগের দুটি শক্তিশালী গ্রুপ চালাতেন সিলেটে। রঞ্জিত ও আজাদ ছাত্রলীগ থেকে উঠে এসে জায়গা করে নেন সিলেট আওয়ামী লীগের গেইটকিপিংয়ে। দিন শেষে আজাদ সিলেট সিটি করপোরেশনের একাধিকবারের কাউন্সিলর। আর রঞ্জিত সরকার বনে যান সবশেষ জাতীয় সংসদের সদস্য।

প্রায়ই তাদের দুই গ্রুপের দখল ও রাজত্বের দ্বন্দ্বে বলি হতে হয়েছে অনেককে। তারা দুজন মিলে সিলেট টিলাগড় পয়েন্টে দুই গ্রুপে সংঘাত-সংঘর্ষ লাগিয়ে নিজেদের শক্তি জাহির করতেন।

দখল, চাঁদাবাজি, তামাবিল-সিলেট মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ, চিনি চোরাচালান, টেন্ডারবাজি- কোনো কিছুই বাদ দিতেন না তারা। রঞ্জিত সুনামগঞ্জ থেকে উঠে এসে সিলেটের টিলাগড়ে প্রথমে কাউন্সিলর আজাদের আশ্রয়ে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ান। ছাত্রাবস্থায় ছিনতাই, লুটপাটসহ টিলাগড় পয়েন্টের বড় অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। একসময় সরে পড়েন আজাদের গণ্ডি থেকে। গঠন করেন নিজের একটি গ্রুপ। সেখানকার আজাদ সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা। এরশাদ সরকারের আমলে পুলিশকে মেরে আজাদ ও মেজর টিলার জাহাঙ্গীরের সঙ্গে গ্রুপ তৈরি করে আলোচনায় আসেন তিনি।

এরপর থেকে একের পর এক অপরাধ করতে থাকেন তিনি। ৫ আগস্টের পর দুজনেই পালিয়ে ভারতে চলে যেতে সক্ষম হন। এ জন্য বড় অঙ্কের টাকা গুনতে হয় তাদের। তারা দুজনেই কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন।  তারা ভারতে থেকেও টিলাগড় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পেরে উঠছেন না। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা দুজনে সক্রিয় এবং সরকার ও দেশবিরোধী পোস্ট করে  চলেছেন নিয়মিত। 

২০১৩ সালের ১৯ মে, ২০১৬ সালের ৭ মার্চ, ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি টিলাগড় ও এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়ার ঘটনা ঘটে। উভয়ে প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকায় কেউ আটক হননি। যেন বিষয়গুলো ছিল একেবারেই স্বাভাবিক।

স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টিলাগড় এলাকায় ৪৫টির বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিটিতেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। প্রভাব বিস্তার, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে টিলাগড়ে। আর এগুলোর সব কটির নাটাই ছিল আলোচিত রঞ্জিত সরকার ও আজাদুর রহমান আজাদ গ্রুপের হাতে!