লবণের পানিতে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া ইন্দ্রপুল এলাকা। লবণবাহী ট্রাক থেকে ঝরে পড়া ক্ষারযুক্ত পিচ্ছিল পানির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসে ইন্দ্রপুলে ২০টি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরতর আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। যাদের সিংহভাগই মোটরসাইকেল আরোহী।
ইন্দ্রপুল লবণশিল্প এলাকায় রয়েছে শতাধিক লবণ কারখানা। সেখানে প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে শত শত ট্রাক করে আসা অপরিশোধিত লবণ আনলোড করা হয়। বেশিভাগ লোড-আনলোডের কাজ চলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উপর। পানিযুক্ত অপরিশোধিত লবণের ক্ষারযুক্ত ঝরেপড়া পানি পিচ্ছিল ও স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলছে ইন্দ্রপুল এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার মহাসড়ক। ফলে সড়কের চলাচলকারী যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের রফিকুল ফিরছিলেন শহর থেকে নিজ বাড়িতে। পটিয়া ইন্দ্রপুল এলাকায় আসলে কক্সবাজার থেকে ফেরা একটি ভ্রমণ বাস লবণের পানিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার মোটরসাইকেলে স্বজোড়ে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থকেই রফিকুল প্রাণ হারান।
চলতি ৩ মার্চ রাতে অভিসেন ও সুজন মিত্র নামের দুই বন্ধু মোটরসাইকেল করে যাচ্ছিলেন বিয়ের দাওয়াতে। মাজার গেইট এলাকায় লবণ-পানিতে পিচ্ছিল রাস্তায় তাদের গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলে অভিসেন মারা যান। তার বন্ধু সুজন গুরতর আহত হয়ে চমেকে চিকিৎসাধীন।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রহিমা বেগমকে নিয়ে মোটরসাইকেল করে চট্টগ্রাম শহর থেকে ফিরছিলেন সুজন নামের এক যুবক। ইন্দ্রপুলের পাশে আশরাফ আলীর শাহ-এর মাজারের পাশে আসলে তার মোটরসাইকেলের ব্রেক কষতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুইজনই রাস্তা থেকে ছিটকে পরে গুরতর আহত হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, দিনের বেলায় সামান্য পরিমাণ লবণবাহী ট্রাক চলাচল করলেও সন্ধ্যার পর সারি সারি লবণের ট্রাক চলাচল করে এ সড়কে। এ সময় লবণ পানি আর ধুলোয় জমাট বাঁধা আস্তরণ তেলতেলে হয়ে উঠে। চলাচলকারী যানবাহন প্রয়োজনের সময় ব্রেক কষলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সন্ধ্যার পর পর থেকে ভোর পর্যন্ত লবণ গাড়ির আধিপত্য চোখে পড়ে ইন্দ্রপুল এলাকা ও বাইপাস সড়কে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক সাজিদ বলেন, সড়ক পথে লবণ পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রাকের নিচে ত্রিপোল বা মোটা পলিথিন বিছিয়ে দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যাতে করে লবণের ক্ষারযুক্ত পানি সড়কে না পড়ে। কিন্তু লবণ ব্যবসায়ী ও ট্রাক চালকরা এসব নিয়মনীতির প্রতি তোয়াক্কা না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লবণ পরিবহন করে যাচ্ছে। ফলে লবণের ক্ষারযুক্ত পিচ্ছিল পানির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হার বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার, চকরিয়া, বাঁশখালী, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎপাদিত এসব লবণ প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণের পটিয়ার ইন্দ্রপুলসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে নিয়ে যেতে হয়। আগে লবণ পরিবহনের জন্য সাগর ও নদী পথকে ব্যবহার করা হত। এখন অধিকাংশ লবণ পরিবহন হয় সড়ক পথে।
আহত ও নিহত পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অপরিশোধিত লবণ থেকে ঝরে পড়া পানিতে প্রতিনিয়ত এত দুর্ঘটনা ঘটলেও তা বন্ধে প্রশাসন থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্বেও খোলা লবণ বোঝায় ট্রাক নিয়ে ইন্দ্রপুল আসা গাড়ির চালক সুমন বলেন, প্রতি ট্রাক প্রতি ১ হাজার টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় এইখানে। তারা প্রশাসনের লোক। তাদের কথায় প্রশাসন আমাদের গাড়ি কখনও আটকে দেই না।
শুস্ক মৌসুম শুরু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে কখন কি হয় তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন বলে জানিয়েছেন দোহাজারি সড়ক বিভাগের নির্বাহী পিন্টু চাকমা।
তিনি বলেন, পিচ্ছিল হওয়া ছাড়াও লবণ-পানি পড়ে মহাসড়কের কার্পেটিং ওঠে যাচ্ছে। পানি ঢুকে সড়কের বিটুমিনাসের নিচের স্তর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে পুরো সড়কের আয়ুষ্কাাও কমে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আবেদন জানানো হলেও তারা দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয় না। তিনি উপজেলার নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এসব রোধ করার প্রস্তাব জেলা প্রশাসনের সভায় তুলে ধরা হবে বলে জানান।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানুর রহমান বলেন, সড়কে দুর্ঘটনার জন্য লবণ পানি মারাত্বক প্রভাব ফেলছে। তাই লবণ পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কে যাতে পানি না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিৎ। নয়তো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।