জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে টানা দশ বছর ধরে বিনা পয়সায় ইফতার এবং সেহরি খাওয়ান রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম। প্রতিদিন তিনশত রোজাদার ব্যক্তি এ আয়োজনে ইফতার এবং সেহরি করেন। খুব বিত্তবান না হলেও এগারো মাসে যা আয় করেন সেখান থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা সঞ্চয় করে রমজান মাস জুড়ে ইফতার এবং সেহরি আয়োজন করে থাকে।
রবিবার (৯ মার্চ) সেহরির ও ইফতার সময় রফিকের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, সেহরি ও ইফতার খাওয়ার ভিড় চখে পড়ার মতো। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল সবাই হাতে প্লেট নিয়ে যেযার মতো করে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। তখন মালিকসহ বয়রাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। খালি নেই কারও হাত। হোটেল জুড়ে চলছে জমজমাট সেহরিপর্ব। টাকা না দিয়ে সেহরি খাবেন সবাই, এটাই রোজার একমাস ধরে রফিক হোটেলের নিয়ম। এই নিয়মটি তিনি প্রায় দশ বছর থেকে ধরে রেখেছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম। তিনি ভাড়া নিয়ে এ হোটেল ব্যবসা করেন। আক্কেলপুর পৌরশহরের কেশবপুর গ্রামে তার বসবাস। তার হোটেলের নামও রফিক হোটেল। তিনি ২০১৬ সাল থেকে দশ বছর ধরে পৌর শহরে রফিক হোটেলে রমজান মাসে নিয়মিত টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন রোজাদারকে।
জানা যায়, দূরদুরান্ত থেকে কলেজ হাটে আসা কৃষক, ট্রেন-বাস যাত্রী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা এই হোটেলে টাকা ছাড়াই নিয়মিত সেহরি ও ইফতারি খাচ্ছেন। খাবারে বেশিরভাগ সময় গরুর মাংস, মুরগীর মাংস, মাছ, ভাজি, আলুর ডাল এবং এক গ্লাস দুধ দিয়ে সমাপ্ত হয় সেহরি পর্ব। আর ইফতারিতে থাকে মাংসের বিরিয়ানী, ছোলা বুট, বুন্দা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, সালাত সাথে একগ্লাস শরবত। রোজাদারেরা তৃপ্তি সহকারে সেহরি ও ইফতার করেন।
গ্রাম থিয়েটার নাট্য অভিনেতা মিজানূর রহমান কাজল বলেন, প্রতি বছর রফিক রমজান মাসে ইফতার ও সেহরি খাওয়ায় এতে গরীব মানুষ উপকৃত হয়। এটি একটি মহৎ কাজ। টাকা কম বেশি সবার ঘরেই আছে কিন্তু খাওয়ানোর মানসিকা সবার নেই। ইফতার খেয়ে টাকা দিতে চাইলেও সে কোন টাকা নেয় না। সকলকে ফ্রিতে ইফতার এবং সেহরি খাওয়ানোই তার ইচ্ছা। রফিক একটা দৃষ্টান্ত, এখান থেকে মানুষকে ও বৃত্তবানদের শিক্ষা নিতে হবে, সমাজে যারা অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ তাদের পাশে দাড়ানো। বিত্তশালী ব্যক্তিরা এমন করে এগিয়ে আসলে সমাজ পরিবর্তন হবে।
পার্শ্ববর্তী উপজেলার ক্ষেতলালের দেউগ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার ভাগ্নাকে নিয়ে এসেছি। রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে এসে এই হোটেলে আসি। এখানে অনেক ভালো মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার পরে বিল দিতে এসে জানতে পারি তিনি টাকা না নিয়ে সেহরি খাওয়ান। তার এই কার্যক্রমে আমাদের মতো অনেক বিপদগ্রস্থ লোকের উপকার হয়।
ইফতার খেতে আসা কমলমতি শিশু আছিব বলেন, আমি এখানে ইফতার খেতে আসছি। ইফতারি খুব ভালো ছিল। ইফতারে বিরিয়ানী, খিরা-টমোটোর সালাতসহ আরও অনেক কিছু।
হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ থাকে। এতে ইফতারি ও সেহরির সময় রোজাদারদের অনেক কষ্ট হয়। বছরের এগারো মাস আমি হোটেল ব্যবসা করে যা আয় হয় তার থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা জমিয়ে রেখে রমজান মাসে সকল রোজাদারদের ইফতার ও সেহরি খাওয়ানোর চেষ্টা করি। ২০১৬ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এ কাজে আমার হোটেলের কর্মচারীরা সহযোগীতা করে। তারাও এই মাসে কোন পারিশ্রমিক নেয় না। মূলত পরকালের মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তোষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি এই কাজ করি। আমি যতদিন বাঁচবো এটা যেন চালু রাখতে পারি এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা করবেন।
আক্কেলপুর কলেজ বাজার বনিক সমিতির সভাপতি কাজী শফি উদ্দীন বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেখছি কলেজ বাজার রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম তার হোটেলে বিনে পয়সায় সেহরি ও ইফতার করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে আক্কেলপুর হাসপাতালে, রেলস্টশনে ও কাঁচাবাজরে বাহির এলাকা থেকে আগত রোজাদাররা অনেক উপকৃত হন। আক্কেলপুরে অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি রয়েছে তবে আমার কলেজ বাজারে থাকা ৫০ বছরে এমন চিত্র নজরে পড়ে নায়। এটি একটি মহৎ কাজ।