রাজনৈতিক সন্ত্রাসে ভীতিকর বরিশাল

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৯:৪৭ এএম

রাজনৈতিক সন্ত্রাসে ভীতিকর বরিশাল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিএনপি নেতাকর্মীদের গত কয়েকদিনের সংঘাত-সংঘর্ষ এবং খুনোখুনির প্রেক্ষাপটে বরিশালে এক ভীতিকর পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে নিজেদের মধ্যকার বিরোধে দলীয় কর্মীকে কুপিয়ে হত্যাসহ টেন্ডার-দখল বাণিজ্য এবং একাধিক রক্তপাতের ঘটনা গোটা বরিশালবাসীকে রীতিমতো হতবাক-বাকরুদ্ধ করেছে। এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হলেও জেলা-মহানগর কিংবা ওয়ার্ড কমিটির বেপরোয়া নেতাকর্মীদের লাগাম যেন টানতে পারছে না দলটির হাইকমান্ড।

এমনকি সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ করে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করতে লন্ডনে অবস্থানরত দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তাও মানা হচ্ছে না। শীর্ষ নেতার নির্দেশনা উপেক্ষা করে দলীয় পরিচয়ে নিজেদের ধান্ধাফিকির করতে গিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দলকে তুমুল বিতর্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে বরিশালে অন্তত ১০টির বেশি বড় অপরাধে জড়িয়ে প্রকাশ্যে এসেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম-পরিচয়। অপকর্মে সম্পৃক্তদের অধিকাংশই বিএনপির পদধারী নেতা এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে নেতৃত্বসারির নেতাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য কোনো অঘটন ঘটা এবং তা প্রকাশ্যে আসার পরে নেতারা তাদের অনুসারীদের অস্বীকার করারও উদাহরণ রয়েছে।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার করাসহ অবৈধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ২ মার্চ বরিশাল শহরের ৩নং ওয়ার্ডের কাউনিয়া হাউজিং এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহীন সরকার ওরফে সোনা শাহীন সদলবলে কুপিয়ে হত্যা করে একই ওয়ার্ডের যুবদল যুগ্ম আহ্বায়ক সুরুজ গাজীকে। এই ঘটনায় ওইদিন রাতে ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সোনা শাহীনের বাসা পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এক দিন বাদে সেই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় ইতিপূর্বে মা-ছেলেসহ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও প্রধান অভিযুক্ত সোনা শাহীন ছিলেন লাপাত্তা। ঘটনার সাত দিনের মাথায় শনিবার রাতে তাকে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে এলিট ফোর্স।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের আসামিকে শনিবার রাতে গ্রেপ্তার খবর নগরবাসীকে স্বস্তি দিলেও বাকেরগঞ্জে ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ফের টেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যেন মোটেও ফুসরত পাচ্ছে না, একটি ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার আগেই নতুন করে আর একটি সন্ত্রাস তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি মহল্লাভিত্তিক সংঘাত-সংঘর্ষ প্রতিরোধ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন ও জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

অবশ্য এরপরেও বরিশাল থেকে রাজনৈতিকসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অতিসত্তর রুখে দেওয়ার অভয় দিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম এবং জেলা পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিন। উভয় কর্মকর্তার অভিব্যক্তি হচ্ছে, পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে, অপরাধী যে দলের হোক না কেন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশ যে আন্তরিক বা অপরাধ রোধে তৎপর রয়েছে, সার্বিক দৃশ্যপটও সেই ধারণা দিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক সন্ত্রাস তো কোনোভাবে প্রতিহত করা যাচ্ছে না, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই গোটা বরিশালে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে।

বিভিন্ন সূত্র অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলছে, সব রাজনৈতিক সন্ত্রাসে বিএনপির নেতাকর্মীরাই জড়িত রয়েছেন। বিশেষ করে এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চোরাকারবারি, ভূমিসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল, এমনকি টেন্ডার সন্ত্রাসেও তারা এক কদম এগিয়ে রয়েছেন।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, কাউনিয়া হাউজিংয়ে যুবদল নেতা সুরুজ হত্যাকাণ্ডের তিন দিনের মাথায় ৫ মার্চ বরিশাল সিটি করপোরেশনে টেন্ডার নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির দুটি গ্রুপ। সেখানে দিনভর হট্টগোল হওয়াসহ সোহেল নামের এক ব্যক্তিকে মারধর খবরে গোটা বরিশাল শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই ঘটনার বেশকিছু ভিডিওচিত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার রাতে বাকেরগঞ্জের নিয়ামতিতে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মো. আসাদুল্লাহকে স্থানীয় বাজারে ফেলে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। রাতেই ছাত্রদল নেতাকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে পাঠিয়েছে পুলিশ এবং নৃশংস এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ামতি ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক সালাম মৃধা ও যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীন ফরাজীসহ জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারে কাজ করছে জেলা পুলিশ।

এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মাথায় গতকাল রোববার সকালে যখন আলোচিত সুরুজ হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সোনা শাহীনকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন; ঠিক তখনই মিডিয়ায় শিরোনাম উজিরপুরে এক সাংবাদিকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিএনপির ব্যানার টাঙিয়ে দখল দিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিকারপুর বন্দরে মাসুম নামের সাংবাদিকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীরা তাদের দখলে রেখেছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম সরফুদ্দিন সান্টুর লোকজন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি দখল দেওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটির শাটারের সাথে বিএনপির ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয়, যা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তাদের একমাত্র সন্তান দলটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং সরফুদ্দিন সান্টুর ছবি সংবলিত।

উজিরপুরের এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কাহিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গতকাল রোববার ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দখলবাজ বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন ভোল পাল্টে বলছেন, সাংবাদিক মাসুমের প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দেওয়া হবে, যা দেশে ফিরে করবেন তাদের নেতা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সরফুদ্দিন সান্টু।

এ তো গেল গত এক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ঘটনা। এর আগে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে গোটা বরিশালে সমান্তরালভাবে দখল সন্ত্রাস শুরু হয়। দখল পাল্টা দখল করতে গিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে পদধারী বেশকিছু নেতাকর্মী দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হুঁশিয়ারি দিয়েছেনÑ যদি কোনো নেতাকর্মী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু কে মানে কার নির্দেশ! নেতার নির্দেশ প্রাপ্তির পরেও বরিশালে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বরিশালে সর্বপ্রথম এই দখল সন্ত্রাস শুরু করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমানের ছোট ভাই মোশারেফ হোসেন। তিনি ৫ আগস্টের পরপরই কেন্দ্রীয় নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নিয়ে নিয়েছেন। কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে তিনি গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে কমিটি ঘোষণা দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে রীতিমতো চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ থাকলেও কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতা সরোয়ারের ভাই হওয়ায় তার বিরুদ্ধাচরণ করার অনেকেই সাহস-শক্তি দেখাচ্ছেন না। এ ছাড়াও শহরের একাধিক ঘাট এবং বাজার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত বা বিতর্কিত নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের সাথে সমন্বয় করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।

বরিশাল একতলা লঞ্চঘাট এবং তালতলীর মৎস্য বাজার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ দুটি বাণিজ্যিক স্পট এখনো আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। বরিশাল সদর উপজেলার তালতলী বাজার থেকে এখনো অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা কালু সিকদার ওরফে সিডা কালু, যিনি বরিশাল মহানগর আ.লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুলের খাস লোক হিসেবে পরিচিত। এই কালুর ওপরেই ভরসা রেখেছেন ইউনিয়ন বিএনপির নেতারা। শোনা যাচ্ছে, অবৈধ এই বাজার থেকে কালু আগের ন্যায় প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন এবং তা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ আলম, ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক জিয়াউল ইসলাম সাবু, সদস্যসচিবক রফিকুল ইসলামকে পৌঁছে দেন।

এই বাজারটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইজারা দেওয়ার কথা বলা হলেও বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন, তালতলীতে তাদের কোনো বাজার নেই। তবে তিনি শুনেছেন পার্কের ভূমিতে বাজার দিয়ে আগে চাঁদাবাজি হতো, তা এখনো চলছে। তাহলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ আলম যে বাজার ইজারা দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা চাইলে ইউএনও বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অতি শিগগির চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, ধান্ধাবাজ নেতাকর্মীরা তাদের আখের গোছাতে গিয়ে শহিদ জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ নেতা তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনাও উপেক্ষা করছেন। সন্ত্রাস এবং দখলবাজি করতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এতে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমান্তরাল এই সন্ত্রাস চলতে থাকলে বরিশাল আর বিএনপির ঘাঁটি থাকবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ এমনিতেই অনেক বিতর্কিত এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে স্থানীয় বিএনপি আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

বরিশালের এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিষয়ে জানতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বরিশাল বিভাগের সমন্বয়ক আব্দুল আউয়াল মিন্টুর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে অসংখ্যবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে হোয়াটসঅ্যাপ অনলাইন দেখাচ্ছে এবং সেখানে প্রশ্ন রাখা হলে তাতেও কোনো উত্তর মেলেনি।

আরবি/জেডআর

Link copied!