মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে হলুদ-মরিচ এবং ধনিয়া ক্রাসিং (গুঁড়া) মিলের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ভেজাল মসলার রমরমা বাণিজ্য। উপজেলার সিংহভাগ মসলার মিলের অসাধু মালিকরা অধিক মুনাফার আশায় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক এমন ক্যামিক্যাল মিশ্রিত মসলা তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পবিত্র রমজান মাসে মসলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভেজাল সিন্ডিকেট চক্রটি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় ভোক্তারা জানান, উপজেলার অধিকাংশ মসলার মিলে ধানের তুষ, মুরগির ফিড, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মটর ডাল, কাপড়ে ব্যবহৃত বিষাক্ত রং, দুর্গন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নিম্নমানের মরিচ), আটা-ময়দার ভুসির সঙ্গে ক্ষতিকর রং এবং রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে বিভিন্ন রকম ভেজাল মসলা তৈরি করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে শহরের সোনার বাংলা রোড, সাগরদিগী রোড, শান্তিবাগ, মৌলভীবাজার রোড এবং শহরতলীর বিলাসের পাড়সহ বিভিন্ন মসলার মিল ঘুরে ভেজাল মসলা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া যায়।
জানা যায়, এ উপজেলায় ১৩টি মসলা মিল রয়েছে। এসব মিল থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মরিচ, হলুদ ও ধনিয়া গুঁড়ো করে দোকানে বিক্রি করছেন। কয়েক মিল মালিকও এই গুঁড়া মসলা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
পাইকারি দোকান থেকে এসব গুঁড়া মসলা কিনে নিচ্ছেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাট-বাজারের ব্যবসায়ী। বিশেষ করে এখানকার চা বাগানগুলোতে এ গুঁড়া মসলা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন পাইকারি দোকান থেকে শুরু করে উপজেলার বিভিন্ন খুচরা দোকানেও অবাধে কম দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ভেজাল গুঁড়া মসলা।
এ ছাড়া এখান থেকে গুঁড়া মসলা কিনে নিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরা। বাজার থেকে এসব মসলা কিনে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন মানুষ, তেমনি রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা।
শহরের একাধিক ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, উৎপাদনকারীরা তিনভাবে বাজারে ভেজাল মসলা সরবারহ করে। কিছু বিক্রি করে প্যাকেট ছাড়া, কিছু বিক্রি করে সাধারণ প্যাকেটে করে আবার কিছু বিক্রি করে নামি-দামি মসলা কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে। আর এসব ভেজাল মসলা কিনে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের এ ব্যাপারে তেমন নজরদারি নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব ব্যবসায়ীদের কাছে মসলা উৎপাদন ও বিক্রির নেই কোনো অনুমোদন। নিয়ম অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সনদপত্র দিলে খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তাকে এসব মসলার মিলে কখনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে এই খোলা বাজারে বিক্রি করা মসলাগুলোর মান সঠিক কি না এবং একই হলুদ ও মরিচসহ অন্যান্য গুঁড়া মসলা কোম্পানির মূল্যর চেয়ে অর্ধেক দামে তারা কীভাবে বিক্রি করছেন এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
এছাড়া এখান থেকে গুঁড়া মসলা কিনে নিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরা। বাজার থেকে এসব মসলা কিনে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন মানুষ, তেমনি রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মসলা উৎপাদনে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মিশ্রণের পাশাপাশি সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে পশুপাখির খাদ্য হিসেবে আমদানি করা এক ধরনের ‘সিড’ বা বীজ গুঁড়া করে ভেজাল মসলা তৈরি করছেন। বীজের গুঁড়ার সঙ্গে ক্ষতিকর লাল রং ও কিছু মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে ভেজাল মরিচের গুঁড়া এবং হলুদ রং ও কিছু হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে ভেজাল হলুদের গুঁড়া তৈরি করা হচ্ছে।
পাশাপাশি মসলার রং আকর্ষণীয় করতেও বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল রং মেশানো হচ্ছে। এর কারণে গুঁড়া মরিচের এবং হলুদের রং আরও গাঢ় হয়। মসলার ওজন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ধানের ভুসি। অসাধু চক্ররা প্রথমে গোপন কারখানায় ভেজাল মসলা উৎপাদন করে। পরে তা প্যাকেটজাত করে খোলাবাজারে সরবরাহ করে। খুচরা বাজারে এসব ভেজাল মসলা কম দামে বিক্রি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা এসব কিনছেন। কিন্তু এসব গুঁড়ায় প্রাণঘাতী কেমিক্যাল ও ভেজাল আছে, সেটি তাদের অজানাই থেকে যায়।
ক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভেজাল গুঁড়া মসলায় বাজার ভরে যাওয়ায় আমার মতো ভোক্তারা ভালো মন্দ না বুঝেই নিম্নমানের মসলা কিনছেন। তাই ভেজাল মসলা বন্ধে প্রশাসনের কঠোর হওয়া দরকার।
ক্রেতা দ্বীপ বোনার্জি বলেন, ভালো খারাপ চেনার কোনো উপায় নেই। তাই বাজারে যা পাচ্ছি তাই কিনে নিচ্ছি।
ভেজাল মসলার বিষয়ে জানতে চাইলে মসলার মিল মালিকরা জানান, মসলায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যাল তারা মিশ্রণ করেন না। উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমোদনের বিষয়ে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সিনথিয়া তাসমিন জানান, ভেজাল মসলা গুঁড়া খেলে পাকস্থলীতে নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে খাদ্যনালিতে আলসার, গ্যাস্টিক, ডায়রিয়া ও কিডনি নষ্ট করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন জানান, শ্রীমঙ্গলে ভেজাল মসলা তৈরিসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে এর আগেও কয়েকটি মিলে অভিযান পরিচালনা করেছি।
এ সময় বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে একাধিক মসলার মিল মালিককে জরিমানা করেছি এবং একজনকে জেলেও দেওয়া হয়েছে। এখন আবার অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযানে ভেজাল মসলা তৈরি বা কোনো অনিয়ম পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইসলাম উদ্দিন জানান, ভেজাল মসলা তৈরি ও বাজারজাত করার বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার মাধ্যমে জানলাম। দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল শহর ও উপজেলাজুড়ে খাদ্যে ভেজাল রোধ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান চলমান রয়েছে বলেও ইউএনও জানান।
আপনার মতামত লিখুন :